মাদকের ছোবল ইয়াবা, আইস জুয়ায় নিঃস্ব ধনীর দুলাল

0
38

রেদওয়ান ইসলাম (ছদ্মনাম)। মেধাবী শিক্ষার্থী। বেড়ে উঠেছেন ঢাকার অভিজাত এলাকা বসুন্ধরায়। বাবা উচ্চপদস্থ  সরকারি কর্মকর্তা। মা গৃহিণী। পরিবারের অন্য সদস্যরাও উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী। পরিবারে অর্থ, বিত্ত, প্রাচুর্যের কমতি নাই। ও লেবেল শেষ করেছেন নামিদামি স্কুল থেকে। তখন থেকেই গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেন। বন্ধু তালিকার সবাই অভিজাত ঘরের।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সিগারেটে হাতেখড়ি হয়। নিয়মিতই বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট খেতেন। স্বপ্ন ছিল পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো নিজেও বড় চাকরি করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই উবে যায়। নিয়মিত ক্লাসে আসা এক বন্ধুর চোখ সবসময় লাল থাকতো। খেতে বসলে অন্তত আড়াই প্লেট বিরিয়ানি একাই খেয়ে ফেলতো। এসব দেখে রেদওয়ানের মধ্যে একটা আগ্রহ জন্মে। যেখানে তিনি এক প্লেট বিরিয়ানি খেতে পারেন না। বন্ধু কীভাবে আড়াই প্লেট খায়। সেই বন্ধুকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করে কোনো উত্তর পাননি। তবে মনের ভেতরে সেই আক্ষেপ থেকেই যায়। ক্লাস নাইনে ওঠার পর ক্লাস পার্টির আয়োজন হয়।

 

সেদিন ওই বন্ধু রেদওয়ানসহ অন্য বন্ধুদের বলে আজ তোদেরকে একটা জিনিস খাওয়াবো। সেটা খেলে তোরাও আমার মতো বেশি বেশি বিরিয়ানি খেতে পারবি। ওইদিনই ওই বন্ধু তাদেরকে এনে গাঁজা খাওয়ায়। প্রথম প্রথম কিছুটা খারাপ লাগলেও একসময় তাদের ভালোই ফিল হতে থাকে। তারপর থেকে শুরু নিয়মিত গাঁজা খাওয়া। সেই থেকে শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। গাঁজা থেকে শুরু হলেও একসময় ইয়াবা, আইসসহ প্রায় সকল প্রকার দামি মাদকে নিজেকে জড়ান। এতে করে তার শুধু স্বপ্নই ভাঙেনি; বরং টাকা, গাড়ি, লেখাপড়া এমনকি নিজের ভালোবাসার মানুষটিও হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। মাদকের নেশায় মত্ত হয়ে নিজের প্রেগনেন্ট প্রেমিকাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এবরশন করান। অথচ সেই প্রেমিকা নিজেও সেটি জানতেন না।

ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার এবরশন হয়েছে।  মাদকের ভয়াল ছোবলে নিঃস্ব হয়ে রেদওয়ান এখন ঢাকার অদূরের একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অভিশপ্ত জীবনের ইতি টানতে নিয়মিত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। যদিও এখন তিনি অনেকটা সুস্থ। মাদক এখন আর তাকে টানে না। এমনকি সিগারেটের নেশাও হয় না। এখন একটাই স্বপ্ন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ হয়ে পরিবারের সঙ্গে সুন্দর জীবনে ফেরা। পুরাতন দিনগুলোর কথা মনে করে এখন শুধু তার অনুশোচনাই হয়। ভাবেন যদি ওই পথে না যেতেন তবে জীবনটা কতোই না রঙিন হতো। আর কোনো সন্তান যেন মাদকের পথে না আসে সেজন্য তিনি সবার কাছে বার্তা দিয়েছেন।   ২০১২ সালে এ লেভেল শেষ করেন রেদওয়ান। সব বিষয়েই ভালো রেজাল্ট ছিল। ভর্তি হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।  আগে থেকে গাঁজার নেশা করতেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ২০১৩ সাল থেকে ইয়াবার নেশা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ক্লাবের সদস্য ছিলেন। সেই ক্লাবের প্রায় সবাই নেশা করতেন। রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট করতেন। একদিন বসুন্ধরায় এক বন্ধুর বাসায় অ্যাসাইনমেন্ট করতে যান। বন্ধুরা কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন। গিয়ে দেখেন তাদের বাসায় অনেক ময়লা। বাসা দেখে মনে হয়নি তারা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। সিগারেট, ইয়াবা সেবন করার ফয়েল যেখানে সেখানে পড়ে আছে। এক বন্ধু তখন তাকে বলে ইয়াবা খাবি? রাজি হননি রেদওয়ান।

তখন ওই বন্ধু অনুরোধ করে বলে একদিন খেয়ে দেখ। যখন রেডি করে বন্ধু তার সামনে নিয়ে আসে তখন ফ্লেভার ভালো লাগে রেদওয়ানের। তারপর ওইদিন থেকেই শুরু হয় ইয়াবা সেবন।  টাকার অভাব ছিল না রেদওয়ানের। বাবা প্রচণ্ড বিশ্বাস করতেন। তাই টাকা, গাড়ি যখন যা দরকার ছিল সবই দিয়েছেন। ইয়াবা শুরুর পর থেকেই তার জীবনে অনেক খারাপ ঘটনা ঘটতে থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে নেশা করতে গিয়ে প্রতিদিন প্রচুর টাকা লাগতো। প্রথম প্রথম সেটি ম্যানেজ করতে পারতেন। পুরোপুরি যখন নেশায় মত্ত হয়ে যান তখন খরচ বেড়ে যায়। টাকার সংকুলান করতে না পেরে ঘরে বাইরে নানারকম ধান্ধা-ফিকির শুরু করেন। ছোট ছোট ছেলেদের ফোনসেট চড় থাপ্পড় দিয়ে নিয়ে নিতেন। বাবার এটিএম কার্ডের টাকা শেষ করে দিতেন। মানিব্যাগ থেকেও টাকা চুরি করতেন।    রেদওয়ান বলেন, মাদক আমার জীবনটাকে উলট-পালট করে দিয়েছে। পরিবার, সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আত্মীয়স্বজন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটেছিল আমার প্রেমিকার সঙ্গে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা প্রেমিকা ছিল। সে কোনো নেশা করতো না। তবে আমার নেশার বিষয়ে জানতো। আমাকে সে বলেছিল যদি নেশার জগত না ছাড়ি তবে সে আমার লাইফে থাকবে না। আমি তাকে জানাই  এদেশে থাকলে কোনো দিন নেশা ছাড়তে পারবো না। এ কথা শুনে সে আমাকে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আড়াই বছর নর্থ সাউথে পড়াশোনা করে আমরা ক্রেডিট ট্রান্সপার করে মালয়েশিয়া চলে যাই। সেখানে গিয়ে আড়াই বছর ড্রাগস ছাড়া ছিলাম। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু। মালয়েশিয়া মাদকের দিক দিয়ে খারাপ। সেখানে অল্প টাকায় অনেক বেশি মাদক পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ইয়াবা কিনতে যে টাকা লাগে সেখানে ওই দামে আরও পিওর আইস পাওয়া যায়। তবুও মাদকের চেয়ে দূরে ছিলাম। এরইমধ্যে আমার প্রেমিকা প্রেগনেন্ট হয়ে যায়। আমি তাকে এবরশন করতে বলি। সে রাজি হয়নি। মালয়েশিয়ায় এবরশন বেআইনি। তাই আমি তাকে নিয়ে দেশে চলে আসি। তারপর চেকআপ করার কথা বলে ঢাকার একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসক রাজি হননি। আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করি। এই বয়সে যদি সে মা হয় তবে তার সমস্যা হবে। তখন চিকিৎসক আমাকে একটি কাগজ দিয়ে বলেন যদি রোগীর স্বাক্ষর নিয়ে আসতে পারি তবে তারা করবে। তখন আমি তাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে সিগনেচার নেই। কিন্তু যেদিন তার এবরশন সেদিনও সে জানে না। সেদিন আমি তাকে বলি চলো আমরা মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে শেষ একবার চেকআপ করে আনি। তাকে হাত ধরে ধরে যখন হাসপাতলে নিয়ে যাই তখনো সে জানে না।

পরে চিকিৎসকরা তাকে একটি ইঞ্জেকশন দেন। সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার এবরশন হয়ে গেছে। তারপর থেকে সে খুব কষ্ট পেয়েছিল। বিষয়টি তার পরিবারকে জানায়। তার বাবা মামলা করতে চেয়েছিলেন। পরে আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলি। আমি আমার প্রেমিকার বিশ্বাসটা ভেঙে  দেই। সাত বছরের সম্পর্ক ছিল। সেটি ভেঙে যায়। সে আর কোনো দিন আমাকে বিশ্বাস করবে না। এখন সে নিউইয়র্ক থেকে মাস্টার্স করছে।   রেদওয়ানের মাদকের জগত থেকে বের হওয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল তার প্রেমিকা। কিন্তু ব্রেকআপের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মনোবল চাঙ্গা করতে আবার নেশা শুরু করে। পাশপাশি সে জুয়া খেলতো। আইস ও জুয়ায় তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দেয়। রেদওয়ান বলে, আইস সেবন করলে মানুষকে সাহসী করে তোলে। কেউ যদি গুলি করে তবে মনে হয় গুলি ঠেকিয়ে  দেয়া যাবে। খুব বেশি কনফিডেন্ট তৈরি হয়। এজন্য জুয়ায় হারলেও মনোবল হারাতাম না। মনে হতো পরের বার সব উঠে আসবে। এরকম করতে করতে আমার টাকা, গাড়ি সবকিছুই শেষ হয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাই পড়ালেখা আর করতে পারিনি। পরে সেখান থেকে চলে যাই থাইল্যান্ডে।

সেখান থেকে ২০২০ সালের শেষে বাংলাদেশে আসি। আহছানিয়া মিশনের মাদক নিয়াময় কেন্দ্রে আমার লাস্ট ট্রিটমেন্ট। এর আগে আমি বহুবার চিকিৎসা নিয়েছি। কিন্তু কোথাও সুস্থ হইনি। কিন্তু আহছনিয়া আসার পর এত ভালো পরিবেশ আর কোথাও পাইনি। বাইরে খেলতে পারছি। এখানে নিয়মিত কাউন্সিলিং হয়, পরিবারের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে সাক্ষাৎ হয়। অন্য সেন্টারে তারা এটাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। চিকিৎসা দেয় না ঠিকমতো, পরিবেশও ভালো না। তাদের টার্গেট যতদিন তারা রোগী রাখতে পারবে ততই তাদের ব্যবসা। প্রথম যখন আহছানিয়া মিশনের এই সেন্টারে আসি তখন খারাপ লাগতো। নার্ভাস হয়ে ছিলাম। এতদিন সিগারেট ছাড়া থাকা সম্ভব না। তবে সেটা এক সপ্তাহ ছিল। আমার মা-বাবা সিগারেট ছাড়াতে পারে নাই। কিন্তু এখানে সম্ভব হয়েছে। আমি চিন্তা করেছিলাম সিগারেট ছাড়া কীভাবে থাকবো? অন্য সেন্টারে সিগারেট খেতে দিতো। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ টা সিগারেট খেতাম। টেনশন থাকলেই সিগারেট খেতাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here