ইসরাইলে বিতর্ক। ইরানের হামলার জবাব কী হবে তা নিয়ে এই বিতর্ক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দৃশ্যত আরেকটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছে। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের কথায় তেমনটাই আভাস মেলে। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, ইরানে যদি ইসরাইল হামলা চালায় তাহলে সেই হামলায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে না।
ওদিকে ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত চীন সংযত থাকার আহ্বান জানালেও শনিবার ইসরাইলের ভিতরে হামলার নিন্দা জানায়নি। ইসরাইলের পিছনে পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন থাকলেও ইরানের পিছনে আছে শক্তিধর চীন ও রাশিয়া। ফলে ইরানকে একেবারে তুচ্ছ করে দেখার কিছু নেই। এমন অবস্থায় ইরানের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বিতর্ক করেছে। তাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে ইসরাইল তার জবাব দেবে নিজেদের মতো করে এবং সময় বেছে নিয়ে।
৭ই অক্টোবর হামাস ইসরাইলে রকেট হামলা করে। তারপর গঠিত যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেন বিরোধী দলীয় নেতা বেনি গান্টস।
তিনি রোববার বিতর্কে ইসরাইল ও পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে আরো সমন্বয় প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল। পুরো বিশ্ব ইরানের বিরুদ্ধে। এটা একটা কৌশলগত অর্জন। আমাদেরকে অবশ্যই ইসরাইলের নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বেনি গান্টস যে কথাগুলো বলেছেন, তাতে ইরানের বিরুদ্ধে আরেকটি হামলাকে উড়িয়ে দেয়া হয়নি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বার বার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আঘাত করেছে ইসরাইল। সাইবার হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে ইসরাইল। ফলে ইসরাইল চাইলেই হামলা চালাতে পারে ইরানের বিরুদ্ধে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জি-৭ বৈঠক আহ্বান করেছেন। সেখান থেকে কী কূটনৈতিক সাড়া মেলে সে জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারে ইসরাইল।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের রকেট হামলার পর থেকে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ উন্মাদনা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দুই সপ্তাহ আগে দামেস্কে ইরানের কন্স্যুলেটে ইসরাইল যে হামলা চালায়, তাতে এই উত্তেজনা আরও তুঙ্গে ওঠে। ইসরাইলের ১লা এপ্রিলের ওই বিমান হামলায় একজন সিনিয়র জেনারেল, তার ডেপুটি এবং অন্য সহকর্মীরা নিহত হন। এই হামলা চলানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করেনি তারা। ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যার পর কী পরিস্থিতি হতে পারে তা আন্দাজ করা উচিত ছিল ইসরাইলের। ইসরাইল প্রকাশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছে তা আশ্বস্ত করার মতো কোনো যুক্তি নয়। তারা বলেছে, কূটনৈতিক মিশনের ভিতরে সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কারণে ওই ভবনটি হামলার টার্গেটে পরিণত হয়েছে বৈধভাবে। কিন্তু খুব দ্রুততার সঙ্গে ইরান জানিয়ে দেয় তারা এর জবাব দেবে। এমন মন্তব্য দেন সুপ্রিম নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি থেকে শুরু করে সর্ব পর্যায়ের নেতারা।
ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের যথেষ্ট সতর্কতা ছিল। দেলাওয়ার রাজ্যে সাপ্তাহিক ছুটিতে ছিলেন জো বাইডেন। তিনি হোয়াইট হাউসে ফেরার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছেন। এরই মধ্যে সুপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়নি ইরান। তারা ধীর গতির ড্রোনও পাঠিয়েছে। কিন্তু রাডার স্ক্রিনে ধর পড়ে যায় তা। ইসরাইলের সবচেয়ে তিক্ত ও কঠোর শত্রু ইরানের পক্ষ থেকে আসা এটা ছিল সবচেয়ে বড় হামলা। এবারই প্রথমবার ইসরাইলের ভিতরে ইরান থেকে সরাসরি হামলা করা হয়েছে। জবাবে তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে কঠোর জবাব দেয়া হবে এমন আশা করেছিলেন বহু ইসরাইলি।
ওদিকে ইসরাইলকে এসব ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে ব্যাপক সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। শনিবার দিবাগত রাতেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোর দিয়ে তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। বলেন, ইসরাইলের নিরাপত্তায় তারা লৌহকঠিন। এর মাধ্যমে ইসরাইলকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন বাইডেন। ইরানের হামলাকে ভণ্ডুল করে দেয়া হয়েছে। এটা ইসরাইলের জয়। ফলে এটা নিয়ে আর উত্তেজনা বাড়ানো যাবে না। ইরানের মাটিতে কোনো সামরিক হামলা চালানো যাবে না। পশ্চিমা একজন সিনিয়র কূটনীতিক বলেছেন, এখন আরও উত্তেজনা বন্ধ করতে একটি সীমারেখা টানা অত্যাবশ্যক। সেই সীমারেখার ভিতর ইরানেরও আশা থাকতে হবে। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে, দামেস্কে ইসরাইল যে হামলা চালিয়েছে তার জবাব দেয়া হয়েছে। যদি এই হামলারও জবাব দেয়া হয়, তাহলে উত্তেজনা আরও ছড়িয়ে পড়বে। দামেস্কে নিজেদের কূটনৈতিক মিশনে ইসরাইলি হামলার জবাব দিয়েছে ইরান। দু’সপ্তাহ ধরে তারা এমন হামলার কথা বলে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে তারা প্রতিশোধ নিয়ে শান্ত হয়েছে। তাদের হামলায় ইসরাইলের যে ক্ষতি হয়েছে, হয়ত তারা এর চেয়ে বেশি ক্ষতি আশা করেছিল। এখন যেটা হচ্ছে সেটা একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নয়। বছরের পর বছর ধরে ইরান তার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র সমৃদ্ধ করে আসছে। তারা হয়তো বহু অস্ত্র ছুড়েছে। তাদের সঙ্গে সর্বাত্মক হামলায় যোগ দিতে পারে লেবাননের যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। তারা ইরানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বর্তমানের এই উত্তেজনার ফলে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হয়তো কিছুটা সন্তুষ্টিতে আছেন। কারণ, ইরানের হামলার বিষয়টিতে গাজা হামলা নিয়ে সংবাদ শিরোনাম থেকে মুছে গেছে গাজা হামলা। গাজায় যে মানাবিক বিপর্যয় ঘটছে, মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই- তখন এসব বিষয়ে সমালোচনা থেকে নিস্তার পেয়েছেন তিনি।