ঘড়ির কাটায় তখন বেলা ১১ টা ৩০মি। কোটি জনতার দৃষ্টি তখন রাজধানীর পিজি হাসপাতালের দিকে। গোটা জাতি বেশ ক’দিন ধরেই উৎকণ্ঠিত। তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার নামে আনা হয় শাহবাগের পিজি হাসপাতালে। প্রায় ২ মাস ধরে কারারুদ্ধ, জনতার ভালোবাসায় সিক্ত নন্দিত নেত্রী। কেমন আছেন আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া? সেটুকু দেখার জন্য উদগ্রীব দেশের আবাল বৃদ্ধ-বণিতা। মিডিয়ার কল্যাণে জাতি দেখল দৃঢ়তার এক ‘উন্নত মম শির’ কে। বিনাঅপরাধে কেবল রাজনৈতিক হিংসার কারণে কারাদন্ড দিয়ে শাসক গোষ্ঠী ভেবেছিলো অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে খালেদা জিয়া টলে পড়বেন বা রোগে-শোকে কাবু হয়ে হার মানবেন। তবে তাদের সে আশায় গুড়ে বালি। পিজি হাসপাতালে গাড়ি থেকে নামার পর জনতা দেখলো সাহসী, দৃঢ়চেতা আর আস্থায় অবিচল দেশনেত্রীকে। পরোক্ষণে বুঝে নিলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে আপোষহীন নেত্রীর অকুতোভয় হিম্মত।
গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী কেবিন ব্লকের সিঁড়ির গোড়ায় আগে থেকে রাখা হয়েছিল একটি হুইল চেয়ার। এক মিনিট পর গাড়িটি ঘুরিয়ে একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় নিয়ে দাঁড় করানো হয়। কারারক্ষী, পুলিশ, ডিবি পুলিশের সদস্যরা কয়েক স্তরের ব্যারিকেডের মাধ্যমে ঘিরে রাখে সে গাড়ি। সাদা পোশাকধারী একজন কারা কর্মকর্তা গাড়ির দরোজায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। তারপর চশমা চোখে, অফ হোয়াইট দেশীয় জামদানী শাড়ি পরিহিত খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। গাড়ি থেকে নেমেই উপস্থিত সাংবাদিকদের হাসি মুখে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় তার চেহারায় অসুস্থতার ছাপ থাকলেও চাহনীতে ছিল এক কঠিন হিম্মতের প্রকাশ। গাড়ি থেকে নামার পরক্ষণেই মহিলা পুলিশ ও কয়েকজন মহিলা কারারক্ষী তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়।
১১টা ২০ মিনিটে তাঁকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর কিছুটা হেঁটে গিয়ে লিফটে ওপরে ওঠেন। হুইল চেয়ার থাকলেও তিনি তা অগ্রাহ্য করেন।
দাদীকে হাসপাতালে আনার খবর পেয়ে পিজিতে ছুটে আসেন ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর দুই কন্যা জাহিয়া রহমান এবং জাফিয়া রহমান। সঙ্গে তাদের মা শর্মিলী রহমান সিঁথি। খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে আনার পর তারা কেবিন ব্লকে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের অনুমতি পাননি। তারপর হাসপাতালের সি-ব্লকের সামনে গাড়িতে বসেছিলেন দীর্ঘক্ষণ। পরে তারা যান হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ের ওয়েটিং রুমে। এক্স-রে শেষে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়ার সময় রেডিওলজি বিভাগের কাউন্টার গেটের ভেতরে তারা কয়েক মিনিটের জন্য কুশল বিনিময়ের সুযোগ পান। এদিকে এক্স-রে শেষে কারাগারের উদ্দেশে গাড়িতে তোলার সময় কেবিন ব্লকের বারান্দাগুলোতে রোগী, নার্স ও চিকিৎসকসহ উৎসুক হাজারও জনতা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংগ্রামী এই নেত্রীকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। খালেদা জিয়াও হাসিমুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন।
কারাগারের অন্ধকার প্রকৌস্টে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও এতোটুকু দমে যাননি খালেদা জিয়া। তাঁর আজকের হাস্যজ্জ্বোল অভিব্যক্তি সেই বার্তাই জানান দিলো।
খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে হাসপাতালে নেয়ার সময় ওই সব সড়কে যান চলাচল সীমিত করে দেয়া হয়। রাস্তাজুড়ে অবস্থান নেয় র্যাব-পুলিশের প্লাটুন প্লাটুন সদস্য। তবুও থেমে নেই জাতীয়তাবাদী আদর্শের সৈনিকরা, ভয় কে জয় করে প্রিয় নেত্রীর মুক্তির দাবিতে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর করে তোলে শাহবাগের আশেপাশের এলাকা। পুলিশ যথারীতি চালায় হামলা আর ধরপাকড়।
বিএসএমএমইউ-এ রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ থেকে দুপুর দেড়টার দিকে গাড়িতে তোলা হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। কঠোর পুলিশি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গাড়ি কারাগারের উদ্দেশে রওনা করে।
একটি টাকাও যেখানে তছরুপ হয়নি, এক পয়সার দুর্নীতির হিসাবও যার বিরুদ্ধে মিলেনি সেই সৎ, সরলপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক নেত্রীকে শুধু জনপ্রিয়তার কারণেই কারাগারে আটকে রেখেছে অনির্বাচিত হাসিনা সরকার।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বৈরাচারী সরকার ভেবেছিলো খালেদা জিয়াকে জেলে পুরলে, একের পর এক জামিন বাতিল করে দিলে, মিথ্যা মামলা চাঙ্গা করলে, চিকিৎসা আর মানবিক অধিকার বঞ্চিত করলে ঘাবড়ে যাবেন এবং পিছু হটবেন। তবে তাদের সে ভাবনায় ছাই। অসুস্থ খালেদা জিয়ার মানসিক দৃঢ়তার কাছে পরাস্থ হলো বাকশাল এবং তার বর্তমান রুপ চলমান একনায়কতন্ত্র। আপোষহীন নেত্রীর এক নতুন প্রত্যয় দেখলো পুরো বাংলাদেশ। গুম-খুন, অপহরণ, নির্যাতন, জেল-জুলুম আর হামলা মামলায় গোটা দেশ যখন জাহান্নামের মতো পীড়াদায়ক করে তোলেছে ভোটহীন, বন্দুকের নল নির্ভর সরকার, তখনো অবিচল বেগম খালেদা জিয়া। শত গঞ্জনা, নিগৃীহন, নির্যাতন আর নিষ্পেষনের ভিতরেও তাঁর মুখে পুষ্পের হাসি। আমাদের দ্রোহের কবি, চেতনা ও মূল্যবোধের বাতিঘর কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-
“আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,”