নয়া আতঙ্ক মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ

0
40

ভুক্তভোগী একজন গৃহিণী। বনানী থানাধীন মহাখালী আমতলী মোড় থেকে জিরাবো যাওয়ার পথে বাসে তার এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাকে অজ্ঞাত ব্যক্তি উপহার হিসেবে একটি কলম  দেন। সেই কলম হাতে নেয়ার পর তার চিন্তা শক্তি কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় এবং অজ্ঞাত ব্যক্তি বাদীর মোবাইল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে নামিয়ে দেয়। কয়েক ঘণ্টা পর ওই মহিলার চিন্তা শক্তি স্বাভাবিক হলে নিজেকে পল্লবী এলাকায় শনাক্ত করেন। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনটি খুঁজে না পেয়ে একজন পথচারীর মাধ্যমে তার ছেলেকে মোবাইলে তার অবস্থান জানালে তার ছেলে তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি তার ছেলের মোবাইল নাম্বারে ফোন করে তার মাকে পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাকে ছাড়ানোর জন্য ১ লাখ টাকা দিতে হবে অন্যথায় গুরুতর মামলায় চালান করে দিবে। পরে ফোন করা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দেয়া বিকাশ নম্বরে ৫৩ হাজার ৯৫৫ টাকা তার ছেলে পাঠায়। অজ্ঞাতনামা বিবাদীরা টাকার জন্য আরও চাপ দিলে বাদীর ছেলের কাছে আর টাকা না থাকায় দিতে অস্বীকৃতি জানান।

অজ্ঞাতনামা বিবাদীরা সর্বশেষ কোরআন শরীফ দানের হাদিয়া বাবদ ৬ হাজার ৫০০ টাকা চাইলে বাদীর ছেলে তাও দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে ওই মহিলা সুস্থ হয়ে ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের বনানী থানায় মামলা করেন।

বনানী থানা মামলার তদন্ত শুরু করার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শফিকুল ইসলাম বাসে একা একা চলাচলরত মহিলা যাত্রীদের টার্গেট করে পাশের সিটে বসে কৌশলে বিভিন্ন আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়ে একটি বিশেষ কলম উপহার দেয়। ওই কলমে গ্রেপ্তারকৃত আসামি শফিকুল ইসলাম একটি বিশেষ চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে রাখে এবং কলমটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে কলমে লেগে থাকা বিশেষ নেশা দ্রব্যের প্রভাবে ভিকটিমের চিন্তা শক্তি লোপ পায় এবং প্রতারকদের কথা মতো কাজ করতে থাকে ভুক্তভোগীরা। সেই সুযোগে প্রতারক শফিকুল ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল এবং মূল্যবান সম্পদ (টাকা, পয়সা, গহনা) ইত্যাদি চেয়ে নেয়। পরে ভুক্তভোগীদের কৌশলে বাস থেকে নামিয়ে প্রতারকদের অন্য সঙ্গীদের নিকট নিয়ে যায়। ভিকটিমের মোবাইল থেকে আত্মীয়স্বজনের নাম্বার সংগ্রহ করে বিভিন্ন থানায় ওসি তদন্ত বা অপারেশন, কখনো ডিবি পরিচয়ে ফোন করে এবং ভিকটিমকে মাদক ও জাল টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে মর্মে জানায়। ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজনদের তারা আরও জানায় যে, কিছু টাকা পয়সা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে; অন্যথায় গুরুতর মামলায় কোর্টে চালান করা হবে। তখন  ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজন হতভম্ব হয়ে প্রতারকদের দেয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠায়।

একই কিসিমের ঘটনা ঘটেছে বারডেম হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বাবার সঙ্গেও। ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার বাবা রোজার শুরুর দিকে কয়েকদিন হাঁটতে বের হয়েছিলেন। একদিন বাসার কিছুদূর যাওয়ার পর এক সিএনজি চালক তার বাবাকে দেখে থেমে যায়। ভেতরে দু’জন প্যাসেঞ্জার রেখে সিএনজি চালক তার বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন ওমানের একটা টাকা হাতে দিয়ে টাকাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায় সিএনজি চালক। কথোপকথনের কিছু পরেই তার বাবা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান এবং প্রতারকদের ফাঁদে পা দেন। ওই সিএনজি দিয়ে তাকে নিয়ে প্রতারকরা এটিএম বুথে যায়। এক বুথে টাকা না পেয়ে আরেক বুথে যায়। সেখানেও না পেয়ে ব্যাংকে যায়। এভাবেই প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা সময় কেটে যায়। চিকিৎসক জানান, বাবার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ থাকায় টাকা তুলে নিতে ব্যর্থ হয় প্রতারকরা। কিন্তু বাবা তাদের হাতে টাকা তুলে দিতে এতটাই উদগ্রীব ছিলেন অফিস থেকে টাকা তুলে দিতে গিয়েছিলেন। অবশেষে সহকর্মীদের জেরার মুখে বাবা ঘটনাটি বললে তারা বাবাকে থামিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে বলেন যে আপনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। পরে বাবা দ্রুত স্বাভাবিক চিন্তাই ফিরে আসেন এবং বুঝতে পারেন যে তিনি মস্ত বড় একটি ভুল করতে যাচ্ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ডেভিল্‌স ব্রেথ বা শয়তানের শ্বাস বা মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় ছিনতাইকারী চক্র। অনেকটা অজ্ঞান বা মলমপার্টির আদলেই চক্রটি কাজ করছে। বলা হচ্ছে এটি ছিনতাইয়ের নতুন কৌশল। তবে অন্য ছিনতাইয়ের চেয়ে নতুন এই কৌশলটি একটু ভিন্ন। অন্যান্য ছিনতাইয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে জোরপূর্বক বা কিছু খাইয়ে অথবা কিছু নাকে লাগিয়ে অচেতন করে টার্গেট ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া হয় মূল্যবান সবকিছু। কিন্তু শয়তানের শ্বাস দিয়ে ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায় প্রতারক চক্রটি। বিশেষ ধরনের এই ড্রাগ যখন প্রতারকরা ভুক্তভোগীর সংস্পর্শে নিয়ে আসে তখন কিছু সময়ের জন্য ভুক্তভোগী স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন না। প্রতারকরা তাকে যা বলেন তিনি তাই করেন। আর এই সুযোগেই তারা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সবকিছু লুটে নেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই ড্রাগটি লিক্যুইড ও পাউডার জাতীয় হয়। খাবারের মাধ্যমে অথবা শ্বাসের মাধ্যমে কিংবা হ্যান্ডশেকের সময় ব্যবহার করা হয়। মূলত এটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চির দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ১ ঘণ্টা। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে প্রতারকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে খুব কম ভুক্তভোগী এসব ঘটনায় মামলা করেন। যে কয়টি মামলা হচ্ছে সেগুলোর তদন্ত করে আমরা আসামি গ্রেপ্তার করছি। তবে বাইরে একা চলাফেলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে অপরিচিত লোকের কাছ থেকে কোনো উপহার সামগ্রী গ্রহণ, অপ্রয়োজনীয় আলাপচারিতা ও কোনো খাদ্য গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। আর কেউ যদি এ ধরনের ঘটনার শিকার হন তবে অবশ্যই পুলিশকে জানাতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here