আমরা মানুষের জন্য লড়াই করে যাচ্ছি, লড়াই করে যাবো: ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

0
83

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা; রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন-৫০ থেকে নির্বাচিত একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের ২৮ মে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর সংসদসদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বিএনপির আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন তিনি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, বিএনপি তাতে অংশগ্রহণ করেনি। আপনারা আন্দোলনের মধ্যে ছিলেন এবং নির্বাচন বর্জন করেছেন। আপনাদের আন্দোলন কি সঠিক পথে রয়েছে বলে মনে করেন?

রুমিন ফারহানা: নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশে একটি নতুন ধারা লক্ষ করেছি আমরা। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মোটামুটি ঘোষিত, আইনসিদ্ধ এবং কার্যত একটি একদলীয় শাসন চালু হলো। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যে বাকশাল কায়েম করেছিলেন সেটাকেই এবার তারা একটি কার্যকর রূপ দিল, চতুর্থ মেয়াদের ক্ষমতায়। এবারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এটাকে আমি কোনোভাবেই নির্বাচন বলতে রাজি নই। নির্বাচন হয়নি বরং হয়েছে আসন ভাগাভাগির একটি খেলা। এ আসন ভাগাভাগির খেলায় আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসন পেয়েছে আর ৬২ আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৫৯ জন আবার আওয়ামী লীগের পদধারী।

জাতীয় পার্টি যে ১১টি আসন পেয়েছে, সেটা সমঝোতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টিরই বেশ কিছু প্রার্থী বলেছেন, যে যেখানে জিতবে বলে সরকার চেয়েছে, সে সেখানে জিতেছে। যাদের সরকার চায়নি তারা জিততে পারেনি। সুতরাং যে নির্বাচনে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, যেখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, যেখানে সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা সেটাকে কোনোভাবেই নির্বাচন বলা যায় না। তবে এটা সত্য যে, এমন একটা ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে গেছে। একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, নির্বাচনের আগে বিএনপির নানা ধরনের কর্মসূচি ও দাবিদাওয়া থাকলেও বিএনপি সেটা আদায় করতে পারেনি। কেন পারেনি সেই উত্তরও আমি দিচ্ছি। ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই আন্দোলন ২০১৮ সালেও জারি ছিল; কিন্তু ২০১৪-১৮ কিংবা ২০২৪ সালের নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এ সময়গুলোতে বিএনপিকে একটি অসম লড়াই লড়তে হয়েছে।

বিএনপিকে যদি শুধু আওয়ামী লীগ দলটিকে রাজনীতির মাঠে মোকাবিলা করতে হতো, তাহলে আমি বিশ্বাস করি বিএনপির জন্য এটা কঠিন কিছুই ছিল না। বিএনপিকে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে, সেই দলীয়করণকৃত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিএনপিকে একা লড়াই করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচনের কাজে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে এমনকি বিচার বিভাগকেও। সুতরাং বিএনপির জন্য এ লড়াইটা হয়ে গেছে অসম এবং অনেক বেশি কঠিন।

আন্তর্জাতিক কমিউনিটির কথা যদি আমরা বলি সেখানেও তারা তাদের স্বার্থ দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। তারা চাইবে বাংলাদেশের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দেশে একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতায় থাকুক। তাহলে তাদের জন্য দরকষাকষি অনেক সহজ হয়। আমি যদি ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের কথা বলি তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পায়ের নিচে কিছুটা হলেও মাটি ছিল। তাদের কথায় শক্তি ছিল। কারণ তারা নির্বাচন করে এসেছিল।

২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ তখন বলেছিল, তিস্তার পানি না দিলে ট্রানজিট দেব না। যদিও তিস্তার পানি আমাদের অধিকার এবং ট্রানজিট একটি স্পেশাল সুবিধা দুটিকে একসঙ্গে তুলনা করা যায় না। তারপরও এটুকু দরকষাকষি শেখ হাসিনা ২০০৮-১৪ মেয়াদে করতে পেরেছিলেন। তারপর আর সেই দরকষাকষির শক্তি শেখ হাসিনার ছিল না। ফলে আমরা দেখলাম তিস্তার পানি তো দূরেই থাক, ৫৪টি অভিন্ন নদী নিয়েও কোনোরকম কিছু হয়নি। উল্টো ফেনী নদীর পানি দিয়ে আসা হলো। এখন আমরা ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট সবই দিচ্ছি। সুতরাং আমাদের প্রতিবেশীরাসহ আন্তর্জাতিক মহল চাইবে দরকষাকষির সুবিধার্থে বাংলাদেশে একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতায় থাকুক। সুতরাং এ সরকারের প্রতি তাদের এক ধরনের সমর্থন রয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক।

বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেছে। এমনকি মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়ে গেছে। নির্বাচন বর্জন থেকে বিএনপির অর্জন আসলে কী?

রুমিন ফারহানা: বিএনপির বেশ কিছু অর্জন রয়েছে এখানে। একটা সময় ধারণা করা হতো বিএনপি এমন একটি দল যেটা ক্ষমতার বাইরে গিয়ে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। তবে বিএনপি প্রমাণ করেছে তারা ভেঙে পড়ার মতো দল নয়। ১৭ বছর ধরে বিএনপির ওপর ভীষণ রকমের নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো বিএনপির নেতাকর্মীরা একইভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দেড় লাখ রাজনৈতিক মামলায় পঞ্চাশ লাখ আসামি। বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এমন কোনো নেতৃবৃন্দ নেই যারা নির্যাতনের শিকার হননি। বিএনপি দলটিকে ভাঙার বহু চেষ্টা হয়েছে, বহু প্রলোভন দেখানো হয়েছে। বিএনপি নেতাদের চাপ দেওয়া হয়েছে, ভয় দেখানো হয়েছে, মামলা দেওয়া হয়েছে এবং সাজা দেওয়া হয়েছে কিন্তু বিএনপিকে ভাঙা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, ১৭ বছর নির্যাতন সহ্য করার মধ্য দিয়ে বিএনপি মানুষের আরও বেশি ভালোবাসা পেয়েছে। মানুষ বিএনপির সঙ্গে রয়েছে এবং মানুষ বারবার বিএনপিকে তাদের সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি একটি সমাবেশ বা কর্মসূচি দিলে শতবাধার পরও সেখানে মানুষের ঢল নেমেছে। বিএনপিকে মানুষ তার অধিকার আদায়ের শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। সুতরাং দিনশেষে মানুষ বিশ্বাস করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যদি ধরে রাখতে হয়, যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় রাখতে হয়, যদি মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা রক্ষা করতে হয়, তাহলে বিএনপির পতাকাতলেই এসে দাঁড়াতে হবে। আমরা মানুষের কাছ থেকে এ সমর্থন এবং ভালোবাসা পেয়েছি।

তৃতীয়ত, মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে কিন্তু আমরা যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি তারা দেখেছি ৫-৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। এমনকি শ্রী রাধা দত্তের মতো ব্যক্তিও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ভোট বর্জন করেছে এটাও বিএনপির একটি বিরাট সাফল্য। বিএনপির তৃণমূলের নেতারা এখনো ঘরে ফিরিতে পারছেন না। তারা বিশ্বাস করেন, একদিন আমাদের দিন আসবে। আমরা লড়াই করছি, আমরা লড়াই করে যাব। বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এই মনোবল অকল্পনীয় এবং ইনশাআল্লাহ একদিন তারা গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সফল হবে।

বিএনপির সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। কিন্তু তারা যে আশা নিয়ে সমাবেশগুলোতে এসেছিলেন, তারা কি একটু হতাশ হননি?

রুমিন ফারহানা: প্রাথমিকভাবে তারা একটু ধাক্কা খায়নি তা নয়। আমরা সবাই হয়তো ধাক্কা খেয়েছি। একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়েই এ দেশটির জন্ম হয়েছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর যদি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতো তাহলে মুক্তিযুদ্ধই হতো না। সুতরাং গণতন্ত্রই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ধ্বংস করে আমি ও ডামির নির্বাচন করা, রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই সাজানো আয়োজন করা, অবশ্যই আমাদের জন্য একটি ধাক্কা ছিল। কিন্তু সেই ধাক্কা আমরা দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছি। নির্বাচনের পরপরই যখন নতুন কর্মসূচি দেওয়া হলো সেখানেও মানুষের স্রোত নেমেছে। মানুষ ধাক্কা খেয়েছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেই ধাক্কা কাটিয়েও উঠেছে।

২৮ অক্টোবরের পর আমরা বিএনপির এক ধরনের নিশ্চুপ অবস্থান লক্ষ করলাম। বিশেষ করে নির্বাচনের আগপর্যন্ত শুধু দু-একটা প্রেস ব্রিফিং ছাড়া প্রায় নিশ্চুপ ছিল বিএনপি। ২৮ অক্টোবরের পর আন্দোলন থেকে বিএনপি কেন নিজেকে গুটিয়ে নিল?

রুমিন ফারহানা: এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের একটি মন্তব্য ধার নিতে চাই। তিনি বলেছিলেন বিএনপির ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে যদি আমরা আটক না করতাম তাহলে হরতাল অবরোধে একটি গাড়িও রাস্তায় চলতে পারত না। তিনি বলেছিলেন বিএনপি নেতাদের সবাইকে এক রাতে জামিন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা রাজি হলেন না। সুতরাং ২৮ তারিখে কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, কারা করেছে এবং কারা এটার সুবিধা নিয়েছে তা মানুষ বোঝে। ২৮ তারিখে বাসে আগুন দেওয়া, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হত্যা করা এসব কিছুর যে রাজনৈতিক ফায়দা আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তা মানুষ দেখেছে। সুতরাং এ ঘটনাগুলো কারা, কেন ঘটিয়েছে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল ভালোই বুঝতে পেরেছে।

২৮ তারিখের পরদিনই ভোরবেলা বিএনপির মহাসচিবকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং দলকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে। এভাবেই নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিএনপিকে একটি হতচকিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখানে সরকার বিএনপিকে ঠেকানোর যে নীল নকশা করেছিল, সেটাতে সফল হয়েছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন কোন পথে?

রুমিন ফারহানা: বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন পথে রয়েছে সেই প্রশ্নের থেকে বড় প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্র কোন পথে রয়েছে? স্বৈরতন্ত্রের ও রকমফের রয়েছে। যেমন উত্তর কোরিয়ার স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে কম্বোডিয়ার স্বৈরতন্ত্র মিলবে না। একেক দেশের স্বৈরতন্ত্র একেক রকম। কিম জং উনের উত্তর কোরিয়াতে শাসকগোষ্ঠীর বাবা-দাদার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের সব মানুষকে একসঙ্গে বসে কাঁদতে হবে। আরেক স্বৈরশাসক রয়েছেন যার একটি বই রয়েছে এবং রাস্তাঘাটে পুলিশ মানুষকে ধরে জিজ্ঞেস করে এ বইয়ের সাত নম্বর কবিতাটি বলো। বলতে না পারলে জেলে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র আবার ওরকম নয়।

কম্বোডিয়াতে নির্বাচনের দিন কোনো কারচুপি করা হয় না বরং নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ ক্যান্ডেল লাইট বা রেসকিউ পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তারপর আওয়ামী লীগ যেমন ছোট ছোট ২৬টা দলকে নিয়ে নির্বাচন করল, কম্বোডিয়ায়ও সেরকম ছোট ছোট দলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ আবার পুরোপুরি সেরকম সিস্টেম ফলো করে না। বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্র নির্বাচনের আগের রাতেই নির্বাচন করে ফেলে। বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্র আমি বনাম ডামির নির্বাচন করে ফেলে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্র কোন পথে সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে গণতন্ত্র কোন পথে সেটা নিয়ে আলাপ করার সুযোগ নেই।

আমরা একটি দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে পড়েছি। রাজনীতির একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আমি দেখতে পাই, আমাদের সামনে একটি দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ এবং এ লড়াইয়ে আমাদের অমুক দল বা অমুক নেতা কেউই উদ্ধার করে দেবে না। বাংলাদেশকে এ অবস্থা থেকে কোনো দল বা কোনো নেতার পক্ষ থেকে উদ্ধার করা খুবই কঠিন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে এটা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই। সে তার ভোটটা প্রয়োগ করতে পারবে, এর বেশি দরকার নেই। মানুষ তার প্রতিনিধি নিজের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত করবে। মানুষই ঠিক করবে বাংলাদেশে কীভাবে পরিচালিত হবে এবং কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের এবং বাংলাদেশের জনগণের দায়িত্ব কারা নেবে সেটা ঠিক করার অধিকারও জনগণের।

মানুষ যদি এটুকুই বুঝে নিজেদের অধিকার আদায় সোচ্চার হয় তাহলে আমাদের লড়াইটা সহজ হবে। মানুষ যদি ভাবে দেশ কীভাবে চলছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না, তাহলে হয়তো আমাদের লড়াইটা আরও কঠিন এবং পথটা অনেক দীর্ঘ হবে।

একটি লড়াই সংগ্রামকে সফল করার জন্য একটি আদর্শ ও ভালো নেতৃত্ব প্রয়োজন হয়। একজন নেতা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। বিএনপির মধ্যে কি সেই মানের পর্যাপ্ত নেতা বা নেতৃত্ব রয়েছে?

রুমিন ফারহানা: আন্দোলন সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো এবং দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতৃত্ব বিএনপির রয়েছে। খালেদা জিয়া এখনো বেঁচে আছেন। তারেক রহমান দূরে আছেন কিন্তু সেখান থেকে তিনি সাধ্য অনুযায়ী দল পরিচালনা করছেন। আমাদের একজন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আছেন। বিএনপি মহাসচিব এমন একজন ব্যক্তি, আপনি যেই দলেরই সমর্থক হন না কেন, তাকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ভেতর থেকেই তাকে শ্রদ্ধা করেন। সুতরাং বিএনপির কাছে এমন নেতৃত্ব থাকার পরও বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য মনে করার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

আপনারা কি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতায় থাকবেন নাকি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে থাকবেন?

রুমিন ফারহানা: নিশ্চয়ই আমরা আন্দোলন সংগ্রামের পথে থাকব। আমরা এ সরকারকে বৈধ মনে করি না, এ সরকারের কোনো ন্যায্যতা নেই। এ সরকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। একটি সাজানো নির্বাচন হয়েছে এবং সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া। সুতরাং এ সরকারকে বাংলাদেশের মানুষের সরকার ভাবার কোনো কারণ নেই। এ সরকারের হাতে দেশ ও জাতি নিরাপদ নয়। যে কারণে আমরা এ সরকারের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতার পথে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং আমরা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে ছিলাম, আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই থাকব।

আপনাদের দলের মধ্যে আন্দোলন সংগ্রামের কৌশলের কোনো ব্যর্থতা দেখেন কি?

রুমিন ফারহানা: নিশ্চয়ই আমাদের আরও আলোচনা করা উচিত। যে কোনো একটি কাজে যদি আমি আপাতদৃষ্টিতে সফল হতে না পারি তবে সেটার পর্যালোচনা করতে হবে। কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল, কী করলে সফল হতো, আমার প্রতিপক্ষের স্ট্রং ও উইক পয়েন্টগুলো কী এবং তাদের আমি কীভাবে মোকাবিলা করব এ আলোচনা হতেই হবে।

অনেকে অভিযোগ করেন, বিএনপি একসময় তারুণ্যনির্ভর দল ছিল। এখন বিএনপি বয়স্কনির্ভর দল হওয়ায় আন্দোলন সংগ্রাম সফল করতে পারছে না। আপনি কী বলবেন?

রুমিন ফারহানা: একাধিকবার দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া একটি দল টানা সতেরো বছর ক্ষমতার বাইরে রয়েছে, এমন একটি দল ভেঙে না গিয়ে শক্তভাবে টিকে রয়েছে, এমনটা আপনি সহজে দেখতে পাবেন না। রাজনীতি মানে অনেকে মনে করেন কিছু সুবিধা পাওয়া, কিছু টাকা-পয়সা বানানো যায় বা চাকরি-বাকরিতে একটু সুবিধা হয়। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে আসলে এসব সুবিধা কোনো কিছুই পাবেন না। বিএনপির সঙ্গে এলে আপনি পাবেন মামলা, হামলা, গুম, পুলিশে নির্যাতন ইত্যাদি। তারপরও বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব আসছে না, তা নয়। বিএনপিতে তরুণরা যুক্ত হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। আমি নিজেই বিএনপিতে যুক্ত হয়েছি বিএনপি বিরোধী দলে থাকার সময়। আমার মতো বিএনপির আরও নেতাকর্মী রয়েছেন, যারা এ দুঃসময়ে বিএনপিতে এসেছেন। বিএনপির নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে ভালো করছে। বিএনপিতে যে নতুনরা রয়েছে আমি তাদের মধ্যে দেখেছি তারা কোনো লোভে রাজনীতিতে আসেনি। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তারা বিএনপিতে আসেনি বরং মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যই তারা বিএনপিতে এসেছেন।

কালবেলা: বিএনপি দলের ভেতরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলতে চান?

রুমিন ফারহানা: ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কত ভাগে ভাগ হয়েছিল? ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনার পর আওয়ামী লীগের কতজন নেতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন? সুতরাং ক্ষমতায় থাকলে খুবই ইন্টিগ্রেটেড মনে হয়। ক্ষমতায় থাকলে সবাইকে মনে হয় খুবই কাছের এবং আপন। ক্ষমতার বাইরে থাকলেই মনে হয় ষড়যন্ত্র এবং শত্রু, তৈরি হয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস। যতটুকু ঘটনা ঘটে অন্যপক্ষ সেটাকে ব্যাপক আকারে বাড়িয়ে প্রচার করে। বিএনপির মধ্যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র বা অসন্তোষের কিছু আমি দেখি না। আমরা খুবই ইন্টিগ্রেটেড একটি দল। তা না হলে অন্তত এ নির্বাচনের আগে সরকার বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত।

বিএনপির অনেক নেতা এখনো জেলে রয়েছেন। তাদের জেল থেকে বের করা অথবা আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আপনারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের আইনজীবীদের যে ফোরাম রয়েছে তারা তাদের মতো করে সব মামলা দলীয় খরচে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমার এলাকার মামলাগুলো আমি আমার আইনজীবী বন্ধুদের মাধ্যমে করে দিচ্ছি। প্রত্যেকে যার যার মতো করে চেষ্টা করছেন।

যে নেতাকর্মীরা জেলে রয়েছেন তাদের পরিবারের পাশে বিএনপির দল থেকে দাঁড়ানো হয়েছে। যারা জেলে রয়েছেন তাদের পরিবারগুলোর সঙ্গে আমাদের দলের মধ্যমসারির নেতারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। এলাকাভিত্তিক ভাগ করে দেওয়া হয়েছে নেতারা কে কোন এলাকায় খোঁজ-খবর রাখবেন। আমি নিজেও কিছু পরিবারে গিয়েছি যাদের বাবা, ভাই বা স্বামী কোনো একজন বিএনপির সঙ্গে থাকার কারণে জেলে রয়েছেন।

আগামীতে বিএনপি কীভাবে এগোতে চায়? বিএনপির পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?

রুমিন ফারহানা: আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা রাজনীতিতে আরেকটি চমৎকার নজির তৈরি করেছি। একসময় বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল লগি-বৈঠার দখলে। মানুষকে পিটিয়ে মারা ছিল রাজনীতি। সেসব বীভৎসতা না করেও যে প্রতিবাদ করা যায়, আন্দোলন চালানো যায় এবং একসঙ্গে থেকে একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায়, আমরা সেটা প্রমাণ করেছি। আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচি চালিয়ে যাব।

আমরা দেখেছিলাম নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। নির্বাচন কেন্দ্র করে বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন-পরবর্তী তাদের মনোভাব কীভাবে দেখছেন আপনারা?

রুমিন ফারহানা: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এমনকি জাতিসংঘ নির্বাচনের একদিনের মধ্যেই প্রত্যেকে বিবৃতি দিয়েছে। তারা স্পষ্ট করেছে যে, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে, বাংলাদেশে কোনো অংশগ্রহণমূলক বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। তবে হ্যাঁ, তারা বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক দেশের সঙ্গেও তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখেছে। তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

বিএনপির আন্দোলন কতটা বিদেশিনির্ভর ছিল?

রুমিন ফারহানা: বিএনপির মহাসচিব এবং মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমরা বিদেশের দিকে তাকিয়ে কোনো আন্দোলন করছি না। তারা সহায়ক হিসেবে হয়তো ভূমিকা পালন করেছেন কারণ তাদের কথা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে। তারা বাকস্বাধীনতা এবং সভা-সমাবেশের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন, সেটা নিশ্চয়ই আমাদের নৈতিকভাবে সমর্থন জোগায়। কিন্তু তাদের দিকে তাকিয়ে বিএনপি আন্দোলন করছে এটা একেবারেই ভুল। আর নিষেধাজ্ঞার কথায় আমি একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যেটা দেখি তা হলো, সরকার খুব পরিকল্পনার সঙ্গে এ নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। সরকার এ নিষেধাজ্ঞার প্রোপাগান্ডা সফলভাবেই চালিয়েছে এবং বাংলাদেশের বেশ বড় একটি অংশের মানুষ এ প্রোপাগান্ডা বিশ্বাস করেছে।

নির্বাচন যেমনই হোক না কেন, আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করেছে। আপনারা কোন পথে এগোবেন?

রুমিন ফারহানা: রাজনীতিতে পাঁচ দিন পর কী হবে সেটা বলা যায় না। পাঁচ বছর অনেক দীর্ঘ একটি সময়। এর আগে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে আবার কোনো কিছু নাও হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন যতটা সহজ একটি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তত সহজ নয়। আপনাকে যদি গুলির মুখে দাঁড়াতে হয়, আপনাকে যদি গুম হয়ে যাওয়ার মুখে দাঁড়াতে হয়, আপনাকে যদি জীবনের পর জীবন দিয়ে যেতে হয়; সেখানে যেতে মানুষ অবশ্যই দুবার ভাববে।

গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সহজ বলেই আমরা দেখেছি ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে আন্দোলন করতে। আমরা ২০০১ সালে বিএনপিকে দেখেছি আন্দোলন করতে। কারণ সেই দুটো সরকার ছিল গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ আন্দোলন করতে পারেন, দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বা গুলির মুখে দাঁড়ানো অনেক কঠিন। আমরা এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছি এবং লড়াই করে যাব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here