বিডিআর বিদ্রোহ, বাংলাদেশের এক ভয়াবহ অধ্যায়ের নাম, এক আতঙ্ক জাগানো রক্তাক্ত উপাখ্যান। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর এর মধ্যে সংঘটিত ওই বিদ্রোহে নিহত হয়েছিলেন বাহিনীটির তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭জন সেনা কর্মকর্তা, নিহত হয়েছিল অপর ১৭জন বেসামরিক নাগরিকও। আকস্মিকভাবে বিডিআর বিদ্রোহ হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, বাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে মানসিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ এমনটাও বেরিয়ে এসেছে এ ঘটনার পর চালানো নানা তদন্তে। ঘটনার ব্যাপকতা এতই ছিল যে, শেষ পর্যন্ত সরকার বাহিনীটির নামই বদলে ফেলে। নতুন করে এর নাম দেয়া হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি।
রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বসেছিল বাহিনীটির দরবার। আগের দিন এই দরবার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত: এই দরবারে বাহিনীর অভ্যন্তরে নানা সমস্যার কথা সৈনিকদের কাছ থেকেই শোনেন বিডিআর প্রধান। সেদিনও স্বাভাবিক নিয়ম আর আনুষ্ঠানিকতায় শুরু হয়েছিল দরবারের আয়োজন। আকস্মিক বিদ্রোহী বিডিআর সৈন্যরা সদর দফতর দখল করে, তারা দরবার হলে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। মিলনায়তনে অধিবেশন শুরু হওয়ার সাথে সাথে বেশ কয়েকজন জওয়ান উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন, তারা বিডিআর কমান্ড থেকে সেনা কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং বিডিআর সৈনিকদের জন্য সমান অধিকারের দাবি জানান। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা মহাপরিচালক এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মিলনায়তনের অভ্যন্তরে জিম্মি করে, পরে তাদের উপর গুলি চালায়। তারা সদর দফতরের প্রধান প্রবেশদ্বারগুলিতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত করে। শুধু দরবার হলেই নয়, তারা অনেক অফিসার এবং তাদের পরিবারকে জিম্মি করেছিল, স্থাপনা ও সম্পদ ভাংচুর করেছিল এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে।
বিদ্রোহীরা বিডিআরের উচ্চ পদস্থ পদগুলো থেকে নিয়মিত সেনা কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারসহ ২২ দফা দাবি উত্থাপন করে। তাদের দাবি ছিল বিডিআর সদস্যদের পদ থেকে পদোন্নতি দিয়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা করা হোক। পাশাপাশি নানা আর্থিক অনিয়মের কথাও তুলে ধরে তারা, বিশেষ করে তাদের অভিযোগ ছিল, অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচির অর্থ নিয়ে বিডিআরএ কর্মরত সেনা সদস্যরা অনিয়ম করেছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী অফিসার হত্যা, লুটপাট ও অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িত ব্যতীত বিদ্রোহীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেন। তবে সংক্ষুব্ধ বিডিআর সদস্যরা তাতে সাড়া দেয়নি। বিদ্রোহের ব্যাপকতায় সারাদেশে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
বিদ্রোহের দ্বিতীয় দিনে বিডিআর ক্যাম্প আছে এমন অন্য ১২টি শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহ দমন ও নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয় সশস্ত্র বাহিনীকেও। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কিছু বিদ্রোহীকে এই আশ্বাস দিয়ে অস্ত্র ছেড়ে দিতে রাজি করিয়েছিলেন যে সেনাবাহিনী বিডিআর সদর দফতরে যাবে না। ফলস্বরূপ, বিদ্রোহীরা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং জিম্মিদের মুক্তি দিতে শুরু করে। পরে বিডিআর সদর দপ্তরে প্রবেশ করে পুলিশ বাহিনী। দপ্তরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন ছিল সেনাবাহিনী। তবে বিডিআর সদস্যদের মধ্যে আতংক কমেনি, তারা অনেকেই পিলখানা থেকে পালানোর চেষ্টা করেন।
বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালে প্রথমে বোঝাই যায়নি, পিলখানার অভ্যন্তরে কি ধরণের নৈরাজ্য, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। বিডিআর হাসপাতালের কাছে একটি গণকবর পাওয়া যায়। সাত ফুট গভীর গর্তের মধ্যে মোট ৪২ জন অফিসারকে মাটিচাপা দেয় বিদ্রোহীরা। কিছু লাশ ড্রেন টানেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। যে ৫৮ টি লাশ পাওয়া যায় তার মধ্যে ৫২ জন ছিল সেনা কর্মকর্তার।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তৎকালীন বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। সদর দপ্তরের দরবার হলে অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায়। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন। দরবার শুরুর পর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ।
কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে। এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা।
বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তাদের প্রাণহানির ঘটনায় সেনাবাহিনীর বিভিন্নস্তরের কর্মকর্তারাও ক্ষুব্ধ হন। ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনানিবাসের সেনা কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে সেনা সদস্যদের শান্ত্বনা জানান। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। সেখানে সেনা কর্মকর্তারা তাদের সহকর্মীদের হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবি করেন। ২ মার্চ ২০০৯ তারিখে ৪৯ সেনা কর্মকর্তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের পুরো সেনা সম্মান দিয়ে সমাহিত করা হয়েছিল।
নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়, যা পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। ৩৭তম রাইফেলস ব্যাটালিয়নের সদস্যদের বিচার শুরু হয়েছিল ১৩ নভেম্বর ২০১০ সালে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করা এবং তাদের অস্ত্র গুলি চালানো, নগরীতে আতঙ্ক সৃষ্টি করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়; আরও ২৫ জন বিদ্রোহে জড়িত থাকার কারণে তিন থেকে দশ বছরের মধ্যে কারাদণ্ড পেয়েছিল। আদালত অভিযুক্ত ২৭৭ জনকেও খালাস দিয়েছিল।
পরে মামলা যায় হাইকোর্টে। ৩৭০ কার্য দিবস শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭শে নভেম্বর রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামীর মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট। ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয় এবং ৫ জন খালাস পান। মামলাটির আপিল এখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে নানা মহলের রয়েছে নানা প্রশ্ন, অনেকেই মনে করেন এর পিছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। অবশ্য রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এসেছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা ক্ষমতা আসার মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে। তাদের সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার চলমান। এর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রতত্ত্বটা দিন দিন জোরালো হওয়ায়, আর বিডিআর সদস্যরা কার্যত: পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করায় বিডিআর বিদ্রোহের মূল কারণগুলো আড়ালে চলে গেছে বলে অনেকের অভিযোগ। তাদের মতে, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যদি তাদের দাবি দাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার কিংবা ন্যায়ানুগ আচরণ না পান তা বাহিনীটির সদস্যদের মধ্যে হীনমন্যতা বোধের সৃষ্টি করতে পারে, যার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে। তাই তাদের পরামর্শ, বিচারিক প্রক্রিয়া চালানোর পাশাপাশি এই বাহিনীটির ভবিষ্যত সদস্যরা যাতে তাদের পরাস্ত কিংবা কোণঠাসা মনে না করেন সে জন্য সরকারকে সমতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাহিনীটিকে আধুনিক, যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নিতে হবে, একই সাথে বিদ্রোহের অন্তর্নিহিত কারণ দূর করতে দৃশ্যমাণ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।