আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বেশি ঘটেছে। এ সময়ে প্রায় কোনো হামলারই বিচজার হয়নি। ক্রমাগত হামলার শিকার হয়ে সনাতন সম্প্রদায়ের সদস্যরা বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন জানায়, ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দুই বছর পর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.৬১% ছিল ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে ৮.৫৪% ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ ০.৬২%, খ্রিষ্টান ০.৩১% এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ০.১৪%। তবে ২০২২ সালের আদমশুমারি দেখাচ্ছে যে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ৮.৫৪% থেকে ৭. ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
তারা জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, বিশেষত ২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশি হিন্দুদের একটি সংগঠন হিন্দু মহাজোটের মতে, কেবল ২০২২ সালে ১৫৪ হিন্দুকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে ১৪৯ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয় এবং তার আগের বছর ১০৮ জন নিহত হয়। অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিন্দুদের ওপর হামলার ৩৬৭৯টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা, ১৬৭৮টি মূর্তি ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা এবং এর ফলে ১১ জন হিন্দুর হয়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণের ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের দুর্গা পূজার সময়। প্রায় দশদিন ধরে চলা এ পরিকল্পিত হামলার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের আক্রমণ করার জন্য আহ্বান জানাতে দেখা গেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কেন সাম্প্রদায়িক হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে তা বিশ্লেষণের জন্য চারটি ঘটনায় তারা একটি সাধারন প্যাটার্ন দেখতে পেয়েছে।
সেগুলো হলো, হামলাকারীরা কম-বেশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় ছিল এবং এই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আক্রমণের রাজনৈতিক ধরনের কারণে স্থানীয় প্রশাসন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়। অন্তত দুটো ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক যোগসূত্রের কারণে হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের যথাযথভাবে তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়নি। প্রায় কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই বিচার কার্য সম্পাদিত হয়নি। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ নেতারা যেমন হামলাগুলোতে জড়িত ছিলেন, তেমনি প্রশাসনের সদস্যরা কেবল হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থই হননি, বরঞ্চ কিছু ক্ষেত্রেও তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। যেমন, গাইবান্ধাতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের
বাড়িতে পুলিশকে অগ্নিসংযোগ করতে দেখা যায়। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ অপরাধীদের কেবল বিচারের আওতায় আনতে বার্থ হয়নি, বরঞ্চ তদন্ত প্রক্রিয়াকেও দীর্ঘায়িত করেছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যাদের নান এসেছে চার্জশিট গঠনের সময় তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তারা আরো জানায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ (বর্তমান সাইবার নিরাপত্তা আইন, সিএসএ) দিয়ে সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক্টিভিস্টদের হয়রানি করা হয়েছে। ২০১৮ এর ৮ অক্টোবর থেকে ২০২৩ এর ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই আইনের অধীনে মোট ১৩০২টি মামলা হয়েছে এবং অন্তত ৩৬৮৭ জনকে আসামী করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই আওয়ামীলীগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমালোচনা করার কারণে মামলার শিকার হয়েছেন। এটা অনুমেয় যে, যদি গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হতো, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের জড়িত থাকার ঘটনা আরও উদঘাটন করা সম্ভব হতো। ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন তদন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার প্রকৃতি ও ধরনের আরও পূর্ণ চিত্র প্রদান করতে পারে।
তারা আরো দাবি করে, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাদের ব্যর্থতার বিপরীতে ২০০১ সালে হামলার পর বিএনপি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে দুই রাজনৈতিক দলের পার্থক্য তুলে ধরে। যদিও আওয়ামী লীগ সর্বদা নিজেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘ত্রাণকর্তা’ হিসাবে উপস্থাপন করে এবং একটি ‘ভোট ব্যাংক’ নিশ্চিত করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নামে একটি মিথ্যা আখ্যান তৈরি করার চেষ্টা করে। বাস্তবে আওয়ামী লীগ নেতারা জমি ও সম্পত্তি দখলের মতো বৈষয়িক সুবিধার জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হামলাগুলোতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন বিএনপি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল তখন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার কিছু ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু একটি স্বাধীন পরিবেশে কাজ করার কারণে গণমাধ্যম এই দুঃখজনক ঘটনাগুলোর দিকে যথাযথ মনযোগ দিয়ে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছিল। যেহেতু বিচার বিভাগ, আইনসভা এবং নির্বাহী বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তারা একে-অপরকে দায়বদ্ধ ছিল, ফলে পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রুখা সম্ভব হয়েছিল।
তারা বলে, ২০০১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে সংবাদপত্রে সহিংসতার খবর প্রকাশের পর, হাইকোর্ট সরকারকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তদন্ত এবং প্রতিবেদন পেশ করার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে তা প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দেয়। পরের বছর ২০০২ সালে সরকার তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। বিএনপি সরকার মুসলিম ও হিন্দুদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার প্রতিবেদন গ্রহণ করে এবং সেগুলো খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দেয়।
‘২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বরিশালের একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০০১ সালে হিন্দু নারীকে ধর্ষণের অপরাধে দুই জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।’
ওই সময়ের কয়েকটি ঘটনা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০২ সালে চট্টগ্রামের রাউজানের বৌদ্ধ বিহারে গণজ্যোতি মহাস্থবির নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় যে, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্দিরে গিয়ে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার কথা বলেন। হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন ৭ জনের মধ্যে ৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ২০০৫ সালে ৭ জনকে দোষী সাব্যস্থ করে আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে। ২০০১ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যাকান্ডের পর ২০০৩ সালে একটি দ্রুত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে চারজন অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড ও চারজনকে যাবজ্জীবনের রায় প্রদান করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, জাতীয় দৈনিকের বিভিন্ন প্রতিবদনের সূত্র উল্লেখ করে এ প্রতিবেদন তৈরি হয়। প্রবেদনটি তৈরি করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট।