বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের তৎপরতা শুরু হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই তৎপরতা আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। মাঝে নির্বাচন থাকায় তা থেমে ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখন দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে তা জনজীবনে নতুন করে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি শূন্যে নামাতে বাল্ক মূল্যহার প্রায় ৮০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চলতি মাস থেকেই তা কার্যকরের প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য চারটি বিকল্প প্রস্তাব বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির ফলে বিতরণ কোম্পনি ও সংস্থাগুলোর লোকসান শূন্যে নামাতে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে পিডিবি।
সমপ্রতি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। এতে বলা হয়েছে, বিতরণ কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর বর্তমান গড় ট্যারিফ আট টাকা ২৫ পয়সা।
তবে বিদ্যমান বাল্ক (ছয় টাকা ৭০ পয়সা) ট্যারিফে ভারিত গড়ে তারা ৫৫ পয়সা বা ছয় দশমিক ৬১ শতাংশ ঘাটতিতে রয়েছে। এর সঙ্গে বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধি করলে তাদের লোকসান আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। তাই লোকসান শূন্যে নামিয়ে আনতে বাল্কের পাশাপাশি খুচরা পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে হবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি অনেক দিনের পেন্ডিং ইস্যু। নির্বাচন ছিল, এজন্য হয়নি। এখন যতদ্রুত সম্ভব দাম বাড়লেই বিদ্যুৎ খাতের জন্য ভালো। কারণ পিডিবি’র তো লোকসান হচ্ছে। আবার ছয়টি বিতরণ সংস্থাও এখন লোকসান করছে। এটাকে সমন্বয় করতে হলেও তো গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দরকার। সরকার এ ব্যাপারে হয়তো দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসি’র গণশুনানি করতে হয়। এরপর সমন্বয়ের বিষয় থাকে। তবে আইন সংশোধন হওয়ায় সরকার নির্বাহী আদেশেও যেকোনো সময়ে দ্রুত ঘোষণা দিতে পারে।
গত ১৪ বছরে ১২ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে অন্তত ১২১ শতাংশ। আর পাঁচ দফায় গড়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭৫ শতাংশ। পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা। এ ছাড়া ডিজেলের দাম বেড়ে প্রায় ২৩৭ শতাংশ আর অকটেন ও পেট্রোলের দাম প্রায় ১৬৯ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে ১৪ বার।
এর আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার একক ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। সেখানে দাম বৃদ্ধির পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম যুক্তি-তর্ক হতো। ফলে ইচ্ছেমতো দাম বৃদ্ধির সুযোগ ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু গত বছর থেকে সরকার নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধির জন্য আইন করে। এরপর গণশুনানি ছাড়াই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ১৫ শতাংশ এবং গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এবারও একই কায়দায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে আগামী এপ্রিল থেকে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের মূল্য সমন্বয় করারও প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। সে ক্ষেত্রে দাম বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে। তবে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পুরোপুরি ভর্তুকিমুক্ত করতে হবে। সরকারও এ ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আসন্ন রমজানের আগেই বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভর্তুকি তুলে নিলে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে। ভর্তুকি শূন্য করতে হলে পাইকারি দাম বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ১২ টাকা ১১ পয়সা করতে হবে। তখন গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়ে হবে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা। সংস্থাটির সুপারিশ হচ্ছে, ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করলে জনগণের জন্য সহনীয় হবে।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তখন ভয়াবহ লোডশেডিং ছিল দেশে। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে সেই সক্ষমতা এখন ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হয়েছে। চাহিদার অনেক বেশি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সংকটের কারণে পুরোপুরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
চলমান গ্যাস সংকট কাটাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানোর কথা বলে আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রমতে, এবার শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম ৪৮ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বাড়তে পারে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম। কারণ আবাসিকে মিটারবিহীন বা পোস্টপেইড গ্রাহকরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেন এমন দাবি করে বিইআরসিতে মূল্যবৃদ্ধির আবদার করেছে দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। তাদের আবদার পূরণ হলে একমুখী চুলার ক্ষেত্রে ৯৯০ থেকে বেড়ে ১৩৮০ এবং দ্বিমুখী চুলায় ১০৮০ থেকে বেড়ে ১৫৯২ টাকা হতে পারে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে বিইআরসি। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে সর্বশেষ গত বছর ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এরপরও চাহিদামতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। মিটারে গ্যাস ব্যবহারকারীদের হঠাৎ জানুয়ারি মাস থেকে অতিরিক্ত মিটার ভাড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকা করায় অসন্তোষ বিরাজ করছে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে। বর্তমানে প্রায় ৪৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২৬০ কোটি। বাসাবাড়িসহ সবখানেই চলছে অস্থিরতা।
কনস্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে সুবিধা দিতে সরকারি অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তা সত্ত্বেও বেসরকারি কেন্দ্রের বেশি দামের বিদ্যুৎ কিনে সরকার এ খাতে বেশি আর্থিক ঘাটতি সৃষ্টি করছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়ে লাভবান করা হচ্ছে। আবার সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় বিদ্যুতের দামও দেয়া হচ্ছে বেশি। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে সেটা অযৌক্তিক। বিদ্যুতের ট্যারিফ নির্ধারণেরও ক্ষেত্রেও রয়েছে অস্বচ্ছতা। অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে বারবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এটা মেয়ে নেয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই মানুষ নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছে, তার উপর এসব পণ্যের দাম বাড়ালে মানুষের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।