‘খরচ তো প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। বাড়ি ভাড়া, খাবার খরচ, শিক্ষা খরচ তো কমানোর সুযোগ নেই। কিন্তু ব্যবসা কমে যাচ্ছে। সঙ্গে কমছে আয়। ঋণ নিয়েছি সেই চাপও বাড়ছে। সব চাপে এখন চ্যাপ্টা। কথাগুলো বলছিলেন ফাইজা এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর ফিরোজ মাহমুদ। দীর্ঘদিন ধরে তার ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। তিনি প্লাইবোর্ড, পারটেক্স, মেলামাইন বোর্ডের ব্যবসা করেন।
ফিরোজ মাহমুদের আয়-ব্যয়ের হিসাবটা কঠিন। হিসাব করতে গেলে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের অঙ্কটা বড়।
তিনি বলেন, এখন আয়-ব্যয়ের হিসাবও করি না। যা আয় হয় তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয়। টান পড়ে মূলধনে। এসব হিসাব করলে চিন্তুায় পড়ে যাই। দোকান ভাড়া, গোডাউন ভাড়া, বাড়ি ভাড়া দেয়ার পর হাতে টাকা থাকে না। একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নেয়া আছে। সেই ঋণও পরিশোধ করতে হয় প্রতিমাসে।
গত বছর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সংলাপে জানানো হয়, ঢাকায় ৪ সদস্যের একটি পরিবারের খাবারের পেছনে প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। এটাকে রেগুলার ডায়েট বলছে সিপিডি। এখানে ২৫টি খাদ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর খাদ্য তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ছোট করলে ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৩১ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্যতালিকা। কিন্তু নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যে আয় তা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনে টিকে থাকা কঠিন। ২০২২ সালে রাজধানীতে ৪ সদস্যের একটি পরিবারের খাবারের পেছনে প্রতি মাসে খরচ ছিল ১৮ হাজার ১১৫ টাকা। আর খাদ্য তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ছোট করলে ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৫ হাজার ৬৮৮ টাকা। অর্থাৎ বছর বছর সাংসারিক খরচ যে বাড়ছে সেটা স্পষ্ট।
নিম্নআয়ের মানুষের কথা সোজাসাপ্টা। সংসারের বোঝা দিন দিন ভারি হচ্ছে। মারুফ হোসেনের একটি চায়ের দোকান আছে। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ৪ জনের পরিবার। তার মাসিক আয় কম, তাই ব্যয়ও করেন সেই হিসাবে। ৬ হাজার টাকায় টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন। এক মেয়ে স্কুলে ও ছেলেকে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করান। লেখাপড়ায় তাদের প্রতিমাসে ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হয়। চাল, ডাল আর কাঁচা সবজি কিনতেই খরচ হয় ১২-১৩ হাজার টাকা। সর্বসাকুল্যে মাসে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয় তার। তবে চায়ের দোকান করে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার মতো আয় হয়। মারুফ বলেন, বাজারে একটু কমদামি পণ্য কিনে খরচ সামলানোর চেষ্টা করি।
সিপিডি জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে দেশের স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে। লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই খাদ্যব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ জাতীয় পণ্য।
মূল্যস্ফিতি বাড়লেও প্রকৃত মজুরি না বাড়ার কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দারিদ্র্য বেড়েছে। এতে খাদ্যে পুষ্টিহীনতা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এই সকল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার জালগুলো খণ্ড-বিখণ্ড এবং রাজনৈতিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ত্রুটি রয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা খণ্ড-বিখণ্ড ও ত্রুটিযুক্ত।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আন্তার্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমছে। কিন্তু আমাদের দেশে মূল্যস্ফিতি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তার মানে দামের উপর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পণ্যের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ দাম কমানোর প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা হচ্ছে না। তার বদলে একটা ‘রেন্টিয়ার’ সমাজ হয়ে গেছে। যার সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতাযুক্ত আছে।
এই সকল বিষয় সংশোধন করা উচিত বলে মনে করেন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে আনা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা জালে যাকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার তার কাছে যাওয়া দরকার। রাষ্ট্র থেকে এই বিষয়ে আরও বেশি মাত্রায় ব্যয় করে পূর্ণাঙ্গ সামাজিক কর্মসূচি করা দরকার। মজুরি কাঠামোতে ন্যূনতম মজুরি ব্যবস্থার রিভিশন হওয়া দরকার। ‘রেন্টিয়ার’ হলো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিষয়। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে রেন্টিয়ার সোসাইটির পরিবর্তন দরকার। বাজারকে বাজারের মতো কাজ করতে দিতে হবে। যে ক্ষমতা প্রবাহের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা সেখান থেকে বের হতে হবে।