ব্যতিক্রমী এক সংসদের যাত্রা শুরু

0
40

যাত্রা শুরু হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের। দেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এই সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন গতকাল প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ভাষণ দিয়েছেন। স্পিকার নির্বাচন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়নসহ রুটিন কাজের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে দিনের কার্যক্রম। এদিন নতুন সংসদের এমপিরা নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি অনেকে সংসদ নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে কুশল বিনিময়, সালাম ও কদমবুছি করেন।

অন্যরকম সংসদে এবার বিরোধী দলের আসনে আছেন মাত্র ১১ জন এমপি। এর বাইরে আওয়ামী লীগের ২২৩ ও স্বতন্ত্র ৬২ জন এমপি আছেন। স্বতন্ত্র এমপিদের ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের নেতা।
অধিবেশনের শুরুতে প্রথমে স্পিকার ও পরে ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্পিকার পদে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার পদে এডভোকেট মো. শামসুল হক টুকু পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন শেষে টানা চতুর্থবার স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে শিরীন শারমিনকে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানান। একাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার আবারো একই পদে প্রার্থী হওয়ায় ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

নতুন সংসদের প্রথম দিনের অধিবেশনে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্সহ দেশ-বিদেশি কূটনীতি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা এবং ভিআইপিদের আত্মীয়স্বজনসহ ৫ শতাধিক অতিথি উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর সংসদের অধিবেশন আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। অধিবেশনে শুরুতে ডেপুটি স্পিকারের শুভেচ্ছা বক্তব্য শেষে দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী স্পিকার পদে নির্বাচন হয়। স্পিকার পদে আবারো ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রস্তাবটি সমর্থন করেন সংসদের প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। এরপর সংসদে কণ্ঠ ভোটে সর্বসম্মতিতে তা পাস হয়। এরপর স্পিকারের শপথ অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ অধিবেশন কিছু সময়ের জন্য মুলতবি করা হয়। এদিকে সংসদের প্রথম অধিবেশনকে ঘিরে পুরো সংসদ ভবন নবীন-প্রবীণ সংসদ সদস্যদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনশ’ আসনের মধ্যে ২২৩ আসনে বিজয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকারি দলের আসনে বসে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আর সংসদীয় ইতিহাসে এবারই প্রথম রেকর্ড সংখ্যক ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য দ্বাদশ সংসদে বসেছে। উদ্বোধনী অধিবেশন দেখতে ভিআইপি গ্যালারিসহ দর্শনার্থী গ্যালারিও ছিল পরিপূর্ণ। সংসদ ভবনে প্রেসিডেন্টের দপ্তরে টানা চতুর্থবার নির্বাচিত স্পিকারকে শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। শপথ গ্রহণ শেষে সংসদ অধিবেশন পরিচালনায় আসেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরপর ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচন হয়। এ পদে পাবনা- ১ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকুর নাম প্রস্তাব করেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবি তাজুল ইসলাম ও সমর্থন করেন মকবুল হোসেন। প্রস্তাবটি ভোটে দিলে সংসদ সদস্যরা ‘হ্যাঁ’ বলে সমর্থন জানান।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন:
অধিবেশনের শুরুতেই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে অগ্রবর্তী থাকা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা সংসদ পরিচালনা করবেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা হলেন- ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, মো. শাহাবুদ্দিন, আফম রুহুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও উম্মে কুলসুম স্মৃতি।

এ ছাড়া অধিবেশনের শুরুতে কুয়েতের আমীর শেখ নাওয়াফ আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহসহ দেশের এক সাবেক মন্ত্রী, এক সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও একজন সাবেক সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। শোক প্রস্তাবে এক মিনিট নীরবতা পালন ও তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মাওলানা হুসামুদ্দীন চৌধুরী।

সংসদের প্রথম সারিতে বসলেন যারা: সরকারি বেঞ্চের (স্পিকারের ডান পার্শ্বে) প্রথম আসনে বরাবরের মতো সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বসেছেন। এর পরের আসনটি ফাঁকা রয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আমির হোসেন আমু, আ ক ম মোজাম্মেল হক, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, ওবায়দুল কাদের ও তোফায়েল আহমেদ বসেন। মাঝের (স্পিকারের মুখোমুখি) অংশের প্রথম সারির বাম দিকের (স্পিকারের দিকে মুখ করে) প্রথম আসনে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বসেছেন। এরপর পর্যায়ক্রমে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ  হুমায়ূন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এবং শেষ আসনে বসছেন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু। বিরোধীদলীয় বেঞ্চের (স্পিকারের বাম দিকে) প্রথম আসনে বসছেন বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তার বাঁয়ে বসছেন সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এরপর পর্যায়ক্রমে বসেছেন জাতীয় পার্টির রুহুল আমিন হাওলাদার, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, স্বতন্ত্র হুসামউদ্দিন, স্বতন্ত্র এমপি আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন।

অধিবেশন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করতে ভিড়: অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণ আগে সংসদ কক্ষে প্রবেশ করেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করেন সংসদ সদস্যরা। সেখানে সরকার দলীয় এমপিদের চেয়েও স্বতন্ত্র এমপিদের অংশগ্রহণ বেশি দেখা গেছে। জাতীয় পার্টির দুই-একজন এমপিকেও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট করেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান  সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ঘিয়ে রঙের জমিনে বেগুনি আঁচল ও পাড়ের জামদানি শাড়ি পরে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটের দিকে সংসদ অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এসময় সিটে বসার আগে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে জড়ো হন সংসদ সদস্যরা। তারা সবাই সংসদ নেতাকে সালাম দেন। কয়েকজন এমপিকে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে। নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়া শাহজাহান ওমরকে কুশল বিনিময় করতে দেখা যায়।

প্রধানমন্ত্রীকে সরকারদলীয় এমপি ছাড়াও স্বতন্ত্র এমপিরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। ভিড়ের কারণে যারা কাছে এসে সালাম করতে পারেননি, তারাও দূরে দাঁড়িয়ে সালাম দেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনাকে।

মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সবাই একদিকে: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশন কক্ষে সদস্যদের আসন বিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি; তবে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সবাই একদিকে বসেছেন। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা যারা এবার মন্ত্রী হননি, তারা আগের মতো সামনের সারিতেই বসেছেন। আর মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর পেছনের সারিতে, তার পেছনে বসেছেন প্রতিমন্ত্রীরা।

এমপিদের সেলফি: চলতি সংসদে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন শতাধিক এমপি। গতকাল প্রথম অধিবেশনে যোগ দিয়ে তারা সেলফিতে মেতে উঠেন। পাশাপাশি এক এমপি আরেক এমপির ছবি তুলে দেন। কেউ কেউ সংসদের একপাশে দাঁড়িয়ে পুরো অধিবেশন কক্ষের ছবি তোলেন। বেলা তিনটায় অধিবেশন থাকলেও দুপুর ২টা ৩০ মিনিট থেকে অধিবেশন কক্ষে আসতে শুরু করেন এমপিরা। প্রথমে তারা নিজেদের আসন খুঁজে নেন। এরপরই মেতে উঠেন ছবি তুলতে। পরে একাধিক এমপির ফেসবুকে সংসদ অধিবেশন কক্ষে তোলা  সেলফি ও ছবি আপলোড করতে দেখা যায়।

ছিলেন না মাশরাফি ও সাকিব: গতকাল প্রথম সংসদের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন না বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নড়াইল থেকে নির্বাচিত এমপি মাশরাফি বিন মোর্তজা ও বর্তমান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এমপি। তারা দুজন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) খেলায় সিলেট ছিলেন বলে জানা গেছে। সে কারণে তারা গতকাল অধিবেশন শুরুর দিন উপস্থিত হতে পারেননি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here