পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনে অনিয়মে ক্ষতি ৬০৮ কোটি টাকা

0
72
  • নীতিমালা লঙ্ঘন করে ব্যাংকের বদলে ৫ লিজিং কোম্পানিতে ৪৩ কোটি টাকা জমা।
  • চেষ্টা করেও লিজিং কোম্পানি থেকে অর্থ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
  • সোলার হোম সিস্টেমের মালামাল না দিলেও ঠিকাদারকে ৫৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল পরিশোধ।
  • প্রতিটি ১৮ হাজার টাকার সোলার হোম সিস্টেম ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা করে ক্রয়। 
  • ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৯ ঋণগ্রহীতার কাছে ২১৮ কোটি টাকা ঋণ অনাদায়ি।

পল্লি অঞ্চলের দারিদ্র্য দূরীকরণে গড়ে ওঠা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) কর্মকর্তারা দারিদ্র্য কমানোর বদলে নিজেরাই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ঋণের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দরপত্র ছাড়া বেশি দামে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কিনেছেন। সংস্থার টাকা ব্যাংকের বদলে নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে জমা করেছেন।

মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের এক বিশেষ নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন পিডিবিএফে ১৬ ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬০৮ কোটি ৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

পিডিবিএফের ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০—এই তিন অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিএজি কার্যালয়। এতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও আর্থিক বিধিবিধান পরিপালন না করায় এসব অনিয়ম হয়েছে। গুরুতর অনিয়মের মধ্যে রয়েছে সরকারি কেনাকাটা বিধিমালা (পিপিআর) ও সরকারি বিধিবিধান ও পিডিবিএফের নিজস্ব বিধান অনুসরণ না করা, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ও সরকারি অর্থ আদায় ও জমার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও শৈথিল্য ইত্যাদি।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিডিবিএফ ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

দারিদ্র্য বিমোচন প্রতিষ্ঠানে মোট ১৬ ধরনের অনিয়ম। পদে পদে লঙ্ঘন করা হয়েছে সরকারি ও প্রতিষ্ঠানটির বিধিবিধান।

ব্যাংকের টাকা লিজিংয়ে

পিডিবিএফ আইন অনুযায়ী, তহবিলের অর্থ ফাউন্ডেশনের নামে বোর্ডের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতে হবে। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহা আইন অমান্য করে তফসিলি ব্যাংকের পরিবর্তে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটালে সংস্থার ৪৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা জমা রাখেন। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আলোচিত পি কে হালদারের। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও এই অর্থ ফেরত আনা যায়নি।

পিডিবিএফ সূত্র জানায়, মদন মোহন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব ছাড়েন। ওই ঘটনায় তিনিসহ সংস্থার তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাদী ছিলেন সংস্থার সাবেক এমডি আমিনুল ইসলাম। তবে গত সেপ্টেম্বরে মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। টাকাও ফেরত পাওয়া যায়নি।

মামলার বিষয়ে আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোর্ডের সিদ্ধান্তে মামলা করেছিলাম। এমন মামলা কীভাবে খারিজ হলো, সেটা অবিশ্বাস্য। আবার বর্তমান কর্তৃপক্ষ খারিজের বিরুদ্ধে আপিল করেনি, এটা সন্দেহজনক।’

মালামাল না দিলেও বিল পরিশোধ

পিডিবিএফের সৌরশক্তি প্রকল্পে সোলার হোম সিস্টেম কিনতে ২০১৪ সালের মে ও জুলাইয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স লাজুক ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। মালামাল সরবরাহ না করলেও ঠিকাদারকে ৫৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার কর্মকর্তারা লিখিতভাবে জানান, ঠিকাদার কোনো মালামাল দেননি।

আশাশুনি উপজেলার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সোলার কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশাশুনিতে আমরা কোনো সোলার সিস্টেম পাইনি। বিষয়টি প্রধান কার্যালয়ে লিখিতভাবে জানালেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।’

এ বিষয়ে জানতে লাজুক ইলেকট্রিকের নম্বরে যোগাযোগ করে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

বোর্ডের সিদ্ধান্তে মামলা করেছিলাম। এমন মামলা কীভাবে খারিজ হলো, সেটা অবিশ্বাস্য। আবার বর্তমান কর্তৃপক্ষ খারিজের বিরুদ্ধে আপিল করেনি, এটা সন্দেহজনক, আমিনুল ইসলাম

অতিরিক্ত দামে কেনাকাটা

বাংলাদেশের সাবেক ছিটমহল এলাকায় সোলার হোম সিস্টেম বসায় পিডিবিএফ। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) নির্ধারিত পাঁচটি বাতি ও একটি পাখার সোলার হোম সিস্টেমের দাম ১৭ হাজার ৯৩৬ টাকা হলেও কেনা হয় ৩৯ হাজার ৫০০ টাকায়। এতে ২০১৭-১৮ থেকে পরের তিন অর্থবছরে ক্ষতি হয় ৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

আবার পিডিবিএফ দরপত্র আহ্বান না করে ও পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই একক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়তি দামে ১৫৮টি কার্যাদেশের মাধ্যমে ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সোলার সিস্টেম কেনা হয়। এতে পিডিবিএফের আর্থিক ক্ষতি হয় ২২ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর অনিয়মিত ব্যয় হয় ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

তিন অর্থবছরে ৮ হাজার ৩৭৯টি সোলার হোম সিস্টেম কেনা হয়, যার ৯৫ শতাংশই অকার্যকর ও নিম্নমানের। ফলে পিডিবিএফের আর্থিক ক্ষতি হয় ১৭ কোটি ২২ লাখ টাকা।

বর্তমানে পিরোজপুরে কর্মরত পিডিবিএফের জ্যেষ্ঠ উপজেলা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা নিলয় মিস্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নমানের সোলার প্যানেল হওয়ায় গ্রাহকদের সেবা দেওয়া যায়নি। পরে সোলার প্রকল্পের লোকজন এগুলো সরিয়ে নেন।

২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়তি দামে ১৫৮টি কার্যাদেশের মাধ্যমে ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সোলার সিস্টেম কেনা হয়। এতে পিডিবিএফের আর্থিক ক্ষতি হয় ২২ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর অনিয়মিত ব্যয় হয় ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

পুরোনো মালামাল দিয়ে বিল

সৌর প্রকল্পে নতুন মালামালের পরিবর্তে পিডিবিএফের পুরোনো ও নষ্ট মালামাল সরবরাহ করেই ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। এই টাকা সংস্থার অতিরিক্ত পরিচালক সহিদ হোসেন (সেলিম) ও তাঁর ভাগনে সাইফুল ইসলামের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়।

পিডিবিএফ সূত্র জানায়, সহিদ বর্তমানে সংস্থাটির মাঠ পরিচালনা বিভাগের প্রধান, সাইফুল বগুড়ার শেরপুর কার্যালয়ে সহকারী হিসাব কর্মকর্তা। এ বিষয়ে জানতে সহিদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

বিপুল খেলাপি ঋণ

পিডিবিএফের ঋণ পরিচালন নীতিমালা অনুযায়ী, ফাউন্ডেশনের বিতরণ করা ঋণ ৪৯টি সাপ্তাহিক কিস্তিতে আদায় করতে হবে। সংস্থাটির ঋণ বিতরণ, আদায় ও ক্রয় কার্যক্রমের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৯ ঋণগ্রহীতার কাছে ঋণের ২১৮ কোটি টাকা অনাদায়ি পড়ে আছে।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, করোনার কারণে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাস ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি বেড়েছে। তবে নিরীক্ষক কার্যালয় বলছে, এই বকেয়া দীর্ঘদিনের।

২০১৭ সালের আগে পিডিবিএফের মাঠ সংগঠক পদে নিয়োগের জন্য ৩০৪টি চাহিদা দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার ফল জালিয়াতি করে বোর্ডের অনুমোদন ও নিয়োগ কমিটির সুপারিশ ছাড়া ৭২৭ জনকে অর্থাৎ চাহিদার অতিরিক্ত আরও ৪২৩ মাঠ সংগঠক নিয়োগ দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ও সংস্থাটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক শফিউল ইসলাম ২৪ প্রার্থীর নম্বর জালিয়াতি করেন।

এই নিয়োগের ফলে পিডিবিএফের ৪৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। এসব মাঠ সংগঠক এখনো কর্মরত।

আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই

সংস্থার মাঠ সংগঠক অনুপ কুমার দাস, খায়রুল আলম খান, প্রমোদ রঞ্জন দে সরকার, আলোক নাথ ও জিতেন্দ্র নাথ মিলে ৩১ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। সাবেক এমডি মদন মোহন ও যুগ্ম পরিচালক শিপ্রা চক্রবর্তী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আনুকূল্য প্রদর্শন করেন।

অভিযোগ রয়েছে, কিশোরগঞ্জ সদরের সহকারী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা ছবি রানী রায় সঞ্চয় ও ঋণের ৩২ লাখ টাকা এবং খুলনার কালিয়া উপজেলার মাঠ কর্মকর্তা নিতিশ কুমার সর্দার ৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ছবি রানীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। মামলায় দোষী সাব্যস্ত ছবি রানীকে ৩১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা জমার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে তাঁকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয়।

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ছবি রানীর ভূতাপেক্ষ (ব্যাকডেটে) আবেদনের ভিত্তিতে সাবেক এমডি মদন মোহন এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে তা নিষ্পত্তি করেন। অন্য অভিযুক্তদের সাজাও মওকুফ করেন। ছবি রানী বর্তমানে পিডিবিএফের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। তাঁর স্বামী তাপস কান্তি চন্দ বর্তমানে পিডিবিএফের সিবিএ সভাপতি।

এত বিস্তৃত অনিয়মের বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। কাগজপত্র যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পিডিবিএফের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারপারসন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

তিন মাস চেষ্টা করে পিডিবিএফের বর্তমান এমডি মউদুদউর রশীদ সফদারের সঙ্গে কথা বলা যায়। ২১ জানুয়ারি এই প্রতিবেদককে ফোনে তিনি বলেন, ‘লিজিংয়ে আটকে থাকা টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে। আমরা আইনি পদক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছি।’

পিডিবিএফের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারপারসন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম  বলেন, এত বিস্তৃত অনিয়মের বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। কাগজপত্র যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি

সিএজির প্রতিবেদনে উঠে আসা অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে এমন জালিয়াতি, লুটপাট, অনিয়ম কাম্য নয়। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here