সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সুচির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। দেশটির তিনটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা জোট করে এই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। গত অক্টোবর থেকে তারা তীব্র আক্রমণ শুরু করেছে সেনাবাহিনী, তথা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। এর ফলে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো যখন একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে, তখন তারা জান্তা সরকারের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ওপর হুমকি সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট শয়ে বলেছেন, সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। অনলাইন জাপান টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। অন্য বিদ্রোহী জাতিগত গ্রুপের সঙ্গে মিলিশিয়ারা একসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অং সান সুচির দলের সদস্যদের সঙ্গে। তারা গঠন করেছে একটি সমান্তরাল সরকার। এর নাম দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। তারা একসঙ্গে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষকরা সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন।
তারা বলেছেন, সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করার আশা অনেকটা আগেই করা হচ্ছে। কারণ, এখনও জান্তা সরকারের প্রধানের ক্ষমতা সুসংহত করার ক্ষমতা আছে।
সীমান্তজুড়ে এই লড়াইয়ে উদ্বিগ্ন চীন উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছে। ডিসেম্বরে এবং জানুয়ারিতে তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দেয়। কিন্তু সেই চুক্তি ধোপে টেকেনি। অব্যাহতভাবে আকাশপথে এবং স্থলপথে হামলার জন্য সামরিক বাহিনীকে দায়ী করছে বিদ্রোহীদের জোট। ফলে ভেঙে যায় চুক্তি।
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে দেশটিতে ভয়াবহ এই গৃহযুদ্ধ মানবাধিকার পরিস্থিতিকে করুণ করে তুলেছে। বৃটেন ভিত্তিক সংগঠন অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স বলছে, গত বছরে বিস্ফোরক অস্ত্রে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭৪৫ জন। ২০২২ সালের তুলনায় এই সংখ্যা শতকরা ১৫৫ ভাগ বেশি।
জোট শুরু করে তিনটি বিদ্রোহী জাতিগত গ্রুপ ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ অভিযান ঘোষণা করে। এর নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ১০২৭’। এতে বলা হয়, আমরা নিষ্পেষক সামরিক স্বৈরাচারকে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর। এটা হলো মিয়ানমারের পুরো জনগোষ্ঠীর চাওয়া।
ওদিকে সামরিক জান্তার নিয়োগ দেয়া ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট শয়ে ৮ই নভেম্বর সতর্কতা দিয়েছেন। বলেছেন, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় জান্তা, তাহলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে।
উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের স্বশাসিত গ্রুপ কোকাং জাতিগত গ্রুপ। সেখানকার রাজধানী লাউক্কাইয়ে সরকারের প্রায় ২০০০ সেনা সদস্য ৪ঠা জানুয়ারি কোকাং মিলিশিয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কোকাং মিলিশিয়ারা হলো বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর জোটের একটি অংশ। নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠেছে মিয়ানমারের সেনারা। তারা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দ্য ইরাবতীর প্রধান সম্পাদক অং জাওয়া ২৯শে ডিসেম্বর একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, এ বছর বিরোধী পক্ষ থেকে অধিক পরিমাণ বিরোধিতা বা আক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সেটা হলে ২০২৪ সালেই অধিক পরিমাণে সেনা সদস্য পক্ষত্যাগ করতে পারেন। এ জন্য সেনা সদস্যদেরকে সেনা কোয়ার্টারে থাকতে বাধ্য করা হবে। সেখানে পর্যাপ্ত আলো নেই। আছে নানা রকম সমস্যা। সেনারা জানেন, জনগণ তাদেরকে ঘৃণা করছে।
এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর কয়েক শত আউটপোস্ট দখলের দাবি করেছে বিদ্রোহী জোট। তারা অক্টোবরে শান রাজ্যে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কমপক্ষে এক ডজন শহর দখল করেছে। তারপর থেকেই পশ্চিমের রাখাইন প্রদেশে লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছে। তা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই হচ্ছে জাতিগত আরাকান আর্মির। সমান্তরাল সরকার এনইউজি সমর্থিত প্রতিরোধ যোদ্ধা দ্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্স এরই মধ্যে জাতিগত কাচিন, কায়িন এবং কায়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অপারেশন চালাচ্ছে।
‘অপারেশন ১০২৭’-এর অধীনে তারা যুদ্ধের গতি বৃদ্ধি করেছে। সমান্তরাল সরকার এনইউজির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ডুওয়া লাশি লা ২১শে জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, একমাত্র লক্ষ্য হলো সেনাবাহিনীকে সরিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে সশস্ত্র গ্রুপ এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করছে।