ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
জাতীয়তাবাদ নিয়ে জাতি ঐতিহাসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। বাংলাদেশের বড় দুটি দল ও তাদের বলয়ের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি বড় দল (ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ) ও তাদের রাজনৈতিক বলয় বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন। অপরদিকে অন্য বড় দল ও বাংলাদেশের মাঠের প্রধান বিরোধীদল (বিএনপি) ও তাদের বলয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন। তাদের এই দ্বিমত ও অবস্থানে সৃষ্ট অস্থিরতা সংবিধানে গিয়েও ঠেকেছে। ফলে এই জাতীয়তাবাদও স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে একাধিকবার সংবিধান সংশোধনের বিষয়বস্তু ছিল।
১৯৭২ সালের অরিজিনাল সংবিধানে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ছিল। এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬(২)’তে এ যা ছিল তা ১৯৭৭ সালে Proclamation Order (যা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ratify করা হয়) এর মাধ্যমে পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করা হয় এভাবে “বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হইবেন”। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৬(২) পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করা হয় এভাবে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন”।
যারা বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন ও তা প্রচার (promote) করেন এবং যারা এটিকে সংবিধানে ঢুকিয়েছেন তাদের কথায়ও বেশ যুক্তি আছে। বাঙালি জাতির ইতিহাস দীর্ঘদিনের, হাজার বছরের। বাঙালিদের আছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, আছে স্বাধীকারের জন্য লড়াই করার দীর্ঘ ঐতিহ্য।
পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত: বাঙালী জাতিই একমাত্র জাতি যারা নিজের ভাষার জন্য তাদের দামাল ছেলেরা জীবন দিয়েছেন। সুতরাং বাঙালী জাতি ও জাতীয়তা এবং এর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক আবেগ ও উচ্ছ্বাস।
কিন্তু বাংলাদেশের তাবৎ জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী তথা বাঙালী জাতীয়তাবাদে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়। প্রথমত: চাকমা, গাঢ়সহ বাংলাদেশে প্রায় পঞ্চাশটি নৃগোষ্টি ও উপজাতি এবং আদিবাসী মানুষ (indigenous people) আছেন তাদের ভাষা বাংলা নয় এবং তারা জাতি হিসেবে নিজেদেরকে বাঙালী মনে করেন না। তাদের বেলায় সমাধান কি? ১৯৭২ সালে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে সন্নিবেশিত করে যখন সংবিধানের ড্রাফট কপি Constituent Assembly’তে উপস্থাপন করা হয় তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ফাউন্ডার জেনারেল সেক্রেটারী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা এটিকে endorse করতে আপত্তি তুলেন। তিনি প্রতিবাদ করে বলেন “Under no definition or logic can a Chakma be a Bangali or a Bangali be a Chakma… As citizens of Bangladesh we are all Bangladeshis, but we also have a separate ethnic identity…”. (সূত্র: “Our Constitution”, The Daily Star, 5 September 2010) (অর্থাৎ “কোনো সংজ্ঞা বা যুক্তির অধীনে চাকমা বাঙালি বা বাঙালি চাকমা হতে পারে না… বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই বাংলাদেশি, কিন্তু আমাদের আলাদা জাতিগত পরিচয়ও আছে”।)
দ্বিতীয়ত: পশ্চিমবঙ্গ অন্য একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অঙ্গরাজ্য। সেখানে অন্তত ৯ কোটি মানুষ আছেন তাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং তারাও বাঙালী হিসেবে পরিচিত বা তারা নিজেদেরকে বাঙালী হিসেবে পরিচয় দেন। বস্তুত: পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ এক সময় একই ভূখণ্ড ও একই জাতি ছিল। তাই স্বভাবত: প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে যদি বাঙালী হোন তাহলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা জাতি হিসেবে কি?
তৃতীয়ত: আধুনিক পৃথিবীর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে একাধিক বা বহু জাতির উপস্থিতি বা অস্থিত্ব থাকে। এটি একেবারেই স্বাভাবিক। ভারতের জনগণের জাতীয় পরিচিতি (national identity) হচ্ছে ভারতীয় (Indian), কিন্তু সেখানে শিখ, তামিল, হিন্দু, মুসলিম ও বাঙালী নামে বহু প্রতিষ্ঠিত ও স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ও জাতি আছে। ঠিক অনুরূপভাবে পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় পরিচিতি হচ্ছে পাকিস্তানী, কিন্তু সেখানে পাঞ্জাবি, বেলুচি, পাঠান বা পশ্তুন, মুসলিম প্রভৃতি নামে বহু স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ও জাতি আছে। মালয়েশিয়ায় ও সিংগাপুরে একই অবস্থা। গণতন্ত্রের সুতিকাগার গ্রেট বৃটেনও একাধিক জাতি নিয়ে গঠিত, যেমন ইংলিশ, স্কটিশ, আইরিশ, ওয়েলস। এছাড়া বৃটেনে বসবাস করেন শতাধিক জাতি ও নৃগোষ্ঠীর মানুষ। এখন বৃটেনসহ উপরোল্লিখিত দেশগুলোর সবাইকে একই জাতি বা জাতীয়তাবাদের অধীনে আনতে গেলেই সমস্যা, অস্থিরতা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হবে।
চতুর্থত: কেবল ভাষার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ নির্ধারণ করতে গেলও সমস্যা ও জটিলতা আছে। পৃথিবীর বহু দেশ একই ভাষায় কথা বলে। যেমন: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ভাষা ইংরেজী। ফ্রান্স ও আফ্রিকার অনেক স্বাধীন দেশের ভাষা ফরাসি। এখন ভাষার ভিত্তিতে এসব দেশের জাতি ও জাতীয়তাবাদ নির্ধারণ করতে গেলে কেমন হবে? উল্লেখিত স্ব স্ব দেশ কি তা মেনে নিবে? এই ধরনের সমস্যার কারণেই সম্ভবত: আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানে নাগরিকত্ব নিয়ে সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও জাতীয়তাবাদ নিয়ে কোনো স্পষ্ট বিধান রাখা হয়নি। দেশ ও রাষ্ট্রে সর্বাধিক বৈচিত্র্য (maximum diversity) এবং সম্মানজনক সহাবস্থান (respectful coexistence) নিশ্চিত করার জন্যই সম্ভবত: জাতীয়তাবাদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বা এত সীমাবদ্ধভাবে (restrictively) এটিকে সংজ্ঞায়িত (defined) করা হয়নি।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইতে তিনি বলেন: “ডিমক্রেসি, সোশিয়ালিজম, ন্যাশনালিজম ও সেকিউলারিজম: এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। ……..কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনওটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লেখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া বাকী সবকটিই সরকারী নীতি – রাষ্ট্রীয় নীতি নয়।……..এই কারণে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধান করিয়া আর- আর বিষয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল।……সে জন্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে শুধু নিরংকুশ গণতন্ত্রের নিশ্ছিদ্র বিধান করিয়া বাকী সব ভাল কাজের ব্যবস্থা করা উচিৎ পার্লামেন্টের রচিত আইনের দ্বারা তা না করিয়া আইনের বিষয়বস্তুসমুহ সংবিধানে ঢুকাইলে সংবিধানের স্থায়িত্ব, পবিত্রতা ও অপরিবর্তনীয়তা আর থাকে না। নির্বাচনে যে দল বিজয়ী হইবেন, সেই দলই তাদের পছন্দমত সংবিধান সংশোধন করিয়া লইবেন, এমন হইলে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের আর কোন দাম থাকে না” (পৃষ্টা ৬১৯)।
তিনি আরো বলেন “রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মতাদর্শকে জনগণের মত বা ইচ্ছা বলিয়া চালাইয়াছেন বহু বার বহু দেশে। সব সময়েই যে খারাপ হইয়াছে, তাও নয়। আবার সব সময়ে তা ভালোও হয় নাই। পাকিস্তানের বেলায় ‘ইসলাম’ ও বাংলাদেশের বেলায় ‘সমাজতন্ত্র, জাতীয়তা ও ধর্ম-নিরপেক্ষতাও’ তেমনিই অনাবশ্যকভাবে উল্লিখিত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিয়াছে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। এসব জটিলতার গিরো খুলিতে আমাদের রাষ্ট্র-নায়কদের অনেক বেগ পাইতে হবে” (পৃষ্টা ৬২০-২১)।
জাতীয়তাবাদের বিষয়টি যদি স্থায়ীভাবে মীমাংসা না করা হয় তাহলে আমাদের সংবিধানে স্থায়ীভাবে একটি উত্তেজনা বা অস্থিরতা রয়েই যাবে। প্রধান দুটি দল যখন ক্ষমতায় আসবে তখন তাদের স্ব স্ব বিশ্বাস ও দর্শনের আলোকে তারা সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করতে থাকবে। এটি ঘটেছে একাধিকবার। অতীত ইতিহাস তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর এর ফলে লিখিত সংবিধানের স্থায়িত্বতা (durability) বারবার হোঁচট খাবে। বিকল্প উপায় হচ্ছে – নাগরিকত্বের বিষয়টি রেখে জাতীয়তাবাদের বিষয়টি জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান থেকে স্থায়ীভাবে বাদ দেয়া। যে দলই ক্ষমতায় আসবে তারা তাদের বিশ্বাস ও দর্শন অনুযায়ী দেশ চালাবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের ঐক্যমত্য হওয়াও অনেকটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তা।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।