বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত নীতিতে দ্বন্দ্ব প্রকট হতে শুরু করেছে

0
99

মন্তব্য প্রতিবেদন: বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারীর নির্বাচন যা আমি তুমি ও ডামি নির্বাচনের আগে আগে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ভারত ও আওয়ামী লীগের স্বার্থেই শেখ হাসিনাকে থামানো উচিৎ।

আওয়ামী আমলের অন্য দুটি নির্বাচন থেকে গত ৭ জানুয়ারী ২০২৪ এর নির্বাচনের একটা বড় পার্থক্য হলো- নির্বাচনের আগেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এবং এটা একদলীয় শাসনের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে তা দেশি-বিদেশী মিডিয়াতে ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছিল। ভারত যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করার নীতি গ্রহণের কথা সবারই জানা। তার পরেও টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয়টা সামনে চলে আসার পর থেকে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা হলো- তবে কি বাংলাদেশ নীতিতে ভারতের থিংক্টট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা তৈরি হতে শুরু করেছে। বিজেপি সরকার আর ভারত রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থানের ভিন্নতা কি দ্বন্দের রুপ নিতে শুরু করেছে? এই বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বিপুল। ভারত উল্টে গেলে ক্ষমতার গণেশও উল্টে যাবে- এমন ধারণা বেশ জনপ্রিয় হওয়াতে এই বিষয়ে মানুষের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। আমেরিকা গণতান্ত্রিক নীতির পথে চলার ছবক ও চাপ কোন কিছুই দিতে কম করে নাই।তারপরেও ভারতের ডানায় ভার করে আরও একটা ভোটবিহীন নির্বাচনের পুলসিরাত পার হতে পারাতে লীগের রাজনীতির জন্য ভারত নির্ভরতা আর অর্থনীতির জন্য চীন নির্ভরতার বিষয়টি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিএনপি অপেক্ষা করেছে ভারতের অবস্থান কোন দিকে থাকে তা দেখার জন্য। এবং সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের পর পরই শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর পরে দলটি সরাসরি বলেছে, ‘ভারতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের জনগন ভোটের অধিকার হারিয়েছে’: রিজভী ( মানবজমিন, ২২ জানুয়ারী ২০২৪) এই প্রসঙ্গ থাক। আগে আমরা দেখে নিতে চাই আসলেই কি ভারতের নীতি-চিন্তকদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে কোন মতবিরোধ দেখা দিয়েছে কি না?

১. ভারতীয় পলিসি-ভাবুকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি দরদরী এমন কয়েক জনের লেখা-লেখি ও বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়লে বিরোধটা বের করতে পারা তেমন কঠিন কিছু না। নির্বাচনের পরে শ্রী রাধার বক্তব্যও ছিল অবাক করা। তিনি সব মিলে ১০% ভোট পড়ে থাকতে পারে বলে মনে করেছেন। এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে লীগের পক্ষে যায় এমন কোন কমেন্ট করা তার জন্য মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে ভারতের নীতিগত বিরোধ বা ভিন্নতার চিত্র পরিস্কার হয় নাই। কিন্তু নির্বাচনের পরে প্রকাশিত ভারতীয় দুইজন বিশ্লেষকের দুইটা লেখা আমরা পাশা-পাশি পড়লে ভারতের অবস্থানে একটা বিরোধের চিত্র ফুটে উঠতে দেখি। ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার ও নরেন্দ্র মোদির সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপ-উপদেষ্টা পঙ্কজ সরণ ভারতের চিন্ত-সংস্থা বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে গত বৃহস্পতিবার ১৮ জানুয়ারী ২০২৪ তারিখে ‘বাংলাদেশ নির্বাচন এবং তার পরের অবস্থা’ -নামে একটি লেখা লিখেছেন। লম্বা লেখা। পুরোটা ধরে ধরে আলাপ না করে আমাদের জন্য দরকারী পয়েণ্টগুলো খেয়াল করলেই আমাদের বক্তব্য পরিস্কার করার জন্য যথেস্ট হবে। এই লেখাতে আওয়ামীলীগের নেতারা ঠিক যেই ভাষায় কথা বলেন। যেভাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেন তিনিও তাই দিয়েছেন। জনগনের ভোটের অধিকার রক্ষার স্বার্থে নির্বাচন বর্জন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে এরা গণতন্ত্রাকি দাবি মনে করেন না । গণতান্ত্রিক দাবি মনে করেন, ভোটহরণের নির্বাচনকে। ফলে বিএনপি ও বিরোধীরাই গণতন্ত্র বুঝেনা। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বুঝলে তারা লিগের অধিনে নির্বাচনে গিয়ে বিরোধী দল হইতো-এমন কথা বলেছেন পঙ্কজ।

অন্যদিকে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে বেশ সরস কৌতুক করেছেন। আমেরিকা দুনিয়ার কোথায় কোথায় অগণতান্ত্রিক সরকারের সাথে কাজ করে তেমন কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। ইরান ও মিশরের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন মার্কিনিদের সেইসব নির্বাচিত সরকার ভালো লাগে না। ফলে পঙ্কজ আমেরিকার সমালোচনা করে বলেন, অনেক ধরণের গণতন্ত্র আছে। একটা দেশে কেমন গণতন্ত্র হবে তা ঠিক করবে সেই দেশের জনগন। তিনি মনে করেন, এখন বিতর্ক শেষ, অনিশ্চয়তা গত এক বছরে যা ছিল তা কেটে গেছে। নতুন সরকার শপথ নিয়েছে। এখন কাজে ফেরার সময়-এটাই পঙ্কজ বাবুর মতামত। সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো সম্পর্কে শেখ হাসিনা বেশ ভালো মতোই অবগত। ফলে তিনি সরকারকে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া থেকে বিরত থেকে পশ্চিমাদের সাথে দূরত্ব কমিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও সুন্দর ও মজুবত করতে দুই দেশের সরকারকেই নসিহত করেছেন। তিনি মনে করেন দুইটি দেশেই আগামি পাঁচ বছর সরকারের কোন পরির্বতন হবে না। আওয়ামী লীগের ভারতের প্রতি যেমন মনোভাব এবং ভারতের আওয়ামী লীগের প্রতি যেমন অবস্থান তার নিখুত প্রতিফলন এই লেখাতে পাওয়া যায়।

২. আরও একটি লেখাটা নিয়ে কথা বলি। ভারত সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েটের একজন উপ-পরিচালক ছিলেন ড. বিভু প্রসাদ রাউট্রে গত সপ্তাহে তিনি ইউরোশিয়া রিভিউয়ে একটি লেখা লিখেন। যার শিরোনাম : ঢাকায় নয়া দিল্লি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ । নির্বাচনকে তিনি প্রহসনের রীতি হিসেবে দেখেন। এই সরকারের আমলের নির্বাচনগুলোতে কয়েক মাস আগেই ফলাফল কি হবে তা ঠিক হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন বিভু প্রসাদ। নরেন্দ্র মোদির অভিনন্দন টুইটে গণতন্ত্র কথাটিই ছিল না। অন্যদিকে ১১ জানুয়ারী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনও সরকারকে স্বাগত জানায়। তিনি মনে করেন, ভারত দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হওয়ার পরেও এমন স্বৈরতন্ত্রের সমর্থন জানায় শুধু মাত্র নিজের কৌশলগত স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। অন্যদিকে নির্বাচনের পর পর যুক্তরাষ্ট্র জানান, এটাকে তারা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মনে করে না। জাতীসংঘ মানবাধিকার নিয়েও উদ্বেগ জানায়। এমন একটি দেশে শুধু কৌশলগত ভাবে ভারতের সমর্থন জানানোর নীতিকে তিনি ধোয়াসাপূর্ণ ব্যাপার মনে করেন। ভারতের বিএনপির সাথে সমস্যা বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। ভারতের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামীলীগ কেন প্রথম পছন্দ তাও আলোচনা করেন। কিন্তু তার পরেও মত দেন দিল্লী বাংলাদেশেকে আরো চায়নার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা থেকে রুখতে সফল নাও হতে পারে। কারণ- এই সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরেও অর্থনীতির অবস্থা ভালো হবে না। বাংলাদেশে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সতর্ক বন্ধুত্ব বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে তাতে ভারতের বাণিজ্য স্বার্থ বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য। সব মিলে এমন অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে দিল্লী একটা ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। শেখ হাসিনা আবারও নির্বাচিত হওয়াতে রাজনৈতিক বিরোধ বাড়বে। সহিংসতার সম্ভাবনা বাড়বে। তিনি মনে করেন, যে কোন মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাওয়া শাসককে সমর্থন করার বদলে ঢাকাকে চাপ দিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌছাতে বাধ্য করার নীতিই দিল্লীকে নিরাপদ রাখতে বেশি কার্যকর হবে। তা না হলে ভারতবিরোধীতা চরম আকার ধারণ করতে পারে যা দিল্লীর নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে।

৩. আমরা দুইজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের বয়ান শুনলাম। এবং তাদের বক্তব্য তথা অবস্থানের ভিন্নতা আশা করি পাঠকের কাছে পরিস্কার। এই দুই আলোচকের পরিচয় ও লেখা থেকে আমরা ভারতের আওয়ামী লীগকে একচ্ছত্র সমর্থনের নীতির মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হচ্ছে এই অনুমানের পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণ পাই। আমরা যদি প্রকৃত অবস্থা বিচার করে দেখি তা হলে দেখবো আসলেই ভারতের এই নীতি দিল্লীকে বিপদে ফেলতে পারে। সরকারের চরম দমন নিপীড়ন ও ভয়ের সংষ্কৃতির বিরুদ্ধে এখানে এতোদিন শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে উঠতে না পারলেও আমেরিকার স্যাংশন ও ভিসানীতির প্রয়োগের ফলে আন্দোলন করার স্পেস তৈরি হতে শুরু করেছে। এখানে যে কোন এন্টি আওয়ামী আপ রাইজিং একই সাথে এন্টি ইন্ডিয়ান আপ রাইজিং হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এতোদিন ভারতের সাথে বিএনপি সরাসরি বিরোধীতায় না গেলও বিএনপির মধ্যে ভারত বিরোধী ও ভারতের প্রতি নমনীয়-দুইটা গ্রুপের মধ্যে বিভেদ ছিল, আছে। কিন্তু কখনোই তারা ভারতের কাছে নতজানু নীতির দিকে অগ্রসর হয় নাই। আর এটাই ভারতকে রিস্ক নিয়ে হলেও লীগের সাথে থাকার দিকে ঠেলে দিয়ে থাকলে-ভারত চরম ভুল পথে হাটছে বাংলাদেশ প্রশ্নে।

এখন দেখা যাচ্ছে ভারতবিরোধী অংশই প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। বিএনপির একটি অংশ মনে করেন, আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনাকে অন্যায় ভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হয়। অথচ এটা বিএনপি আমলের একটি সফলতা। অস্ত্রগুলো ভারতের মাটিতে পৌছার আগেই বিএনপি সরকার আটক করতে সক্ষম হয়। যার জন্য বিএনপি ভারতের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আশা করতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার উল্টা বয়ান বেশি প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ফলে ভারত লীগকে টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতাকে এতোটাই বিস্তৃত করেছে যে, অনেক ভারতীয় মিডিয়া নির্বাচনের ‘র’-এর ভূমিকা নিয়ে প্রসংশা করে। বাংলাদেশেও বিষয়টা এখন ওপেন-সিক্রেট। ফলে ভারতের বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কথা কিন্তু তারা বেছে নিয়েছে শত্রুতার পথ। যা শেষ পর্যন্ত এই রিজিয়নে ভারতকে এক ঘরে করে ফেলতে পারে। অন্যদিকে সোসাল মিডিয়াতে ভারতীয় পন্য বর্জনের ডাকে যে ধরণের সাড়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তা ৭ জানুয়ারীর নির্বাচনের মতোই আরও একটি নীরব গণ-প্রতিরোধের অবস্থা- ভারতের বাণিজ্যের জন্য তৈরি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এছাড়া ভারতের পশ্চিম বাংলার বিজেপি বিরোধী প্রবল অবস্থানের সাথে বাংলাদেশের মানুষের মোদি বিরোদী মনোভাবে জোয়ার যুক্ত হলে- বাংলায় মোদির আধিপত্য বিস্তারের অনেক দিনের স্বপ্ন আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সম্প্রতি বাবরি মসজিদ প্রঙ্গনে রাম মন্দির উদ্বোধনে মোদি যে দৃষ্টিকটু আনুষ্ঠানিকতা দেখালেন তা ভারতের সম্প্রীতিবাদি জনগন যেমন ভালো ভাবে নেয় নাই। বাংলাদেশের সোসাল মিডিয়াতে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ও ক্ষোভ দেখা গেছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের ভারত বিরোধীতার পালে বেশ জোরে একটা হাওয়ার ঝাপটা দিয়ে গেল।

শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে চারদিকের ভারত বিরোধীতার জোয়ারকে আরও উস্কে দিয়ে ভারত নিজের স্বার্থ কতটা হাসিল করতে পারবে, নিরাপত্তা কতোটা সুরক্ষিত থাকবে- এটাই এখন ভাবাচ্ছে নীতি-গবেষকদের। অনেকে মনে করেন- বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত মার্কিন অবস্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ধীরে ধীরে আমেরিকার অবস্থানের কাছা-কাছি আসার পথে হাটলে চীনকে ঠেকানোতে যেমন মার্কিন সহযোগিতা বাড়বে, নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকিও কমবে। আমেরিকা সুপার-পাওয়ার। আর সুপার পাওয়ার কখনও রিজিওনাল পাওয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের নীতি-কৌশল গ্রহণ করে না। ফলে ভারত যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে গিয়েএই ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখার পথে অটল থাকে তাকে ঘরে-বাইরে এর জন্য চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে বলেই মনে হয়।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here