বাংলাদেশে এখন দু’টি সংসদ চলমান। একাদশ সংসদ এবং দ্বাদশ সংসদ। যেহেতু রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত ভেঙে দেননি তাই একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৯শে জানুয়ারি। রাষ্ট্রপতি ভেঙে না দিলে এবং মেয়াদের শেষ না হলে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং একাদশ সংসদ এখনো বিদ্যমান। আবার একাদশ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় দ্বাদশ সংসদের সদস্যগণ শপথ নিয়েছেন। তাহলে একাদশ সংসদের ৩৫০ (৩০০+৫০) এবং দ্বাদশ সংসদের ৩০০ জন অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন ৬৫০ জন সংসদ সদস্য। এর মাঝে ৬০০ জন প্রত্যক্ষ ভোটে আর ৫০ জন মহিলা সদস্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। সংসদের সদস্য সংখ্যা হঠাৎ করে দ্বিগুণ হয়ে যাবে বা দু’টি সংসদ একসঙ্গে কার্যকর থাকবে- এমন লেজেগোবরে অবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই, শুধু বাংলাদেশ ছাড়া।
বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ আসন নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠনের সাংবিধানিক নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এখন তিনশ আসনে ৬০০ সংসদ সদস্য রয়েছেন।
অর্থাৎ প্রতিটি আসনের বিপরীতে দু’জন করে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বর্তমান। এটি সংবিধানের সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক এবং প্রজাতন্ত্রের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। সংবিধানের ন্যূনতম চেতনা বা ন্যূনতম নির্দেশনা অনুসরণ করলেও এই ধরনের অসাংবিধানিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে না। সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং স্পিকার সংবিধান প্রশ্নে কতো বড়ো উদাসীন তার একটি জাজ্বল্যমান প্রমাণ উত্থাপন করছি- নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ১২৩ এর ৩ (ক) অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছে। একাদশ সংসদের মেয়াদ ২৯শে জানুয়ারি পর্যন্ত। যেহেতু মেয়াদ অবসানের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয় সেহেতু সংবিধানের একটি শর্ত- চলমান সংসদের উপরোক্ত ৯০ দিন শেষ হওয়ার পর দ্বাদশ সংসদ কার্যকর হবে। যে নির্বাচন কমিশন ২৯শে জানুয়ারির পূর্বের ৯০ দিন নির্ধারণ করলো সেই নির্বাচন কমিশন কীভাবে দ্বাদশ সংসদ সদস্যদের গেজেট ৯ই জানুয়ারি প্রকাশ করে? আবার সংসদের স্পিকার কীভাবে ১০ই জানুয়ারি শপথ গ্রহণের আয়োজন করেন এবং কীভাবেই বা ১১ তারিখ সরকার গঠিত হতে পারে?
আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে- সংসদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। সংবিধানের ৭২ (৩) এ বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’। কিন্তু আমাদের সরকার, সংসদ এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংবিধানকে উপেক্ষা করার কারণে একাদশ সংসদের মেয়াদ দাঁড়ালো- ৪ বছর ১১ মাস ১১ দিন। এমনিভাবে দশম সংসদের মেয়াদ দাঁড়িয়েছে ৪ বছর ১১ মাস ২ দিন। সংসদের মেয়াদ তো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে না। বিগত ১১টি সংসদের মাঝে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং ষষ্ঠ সংসদ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। আর নবম, দশম এবং একাদশ সংসদ ৫ বছর মেয়াদ অতিবাহিত করতে পারেনি সংবিধানের প্রতি সরকারের আনুগত্যের অভাবে।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। এর কোনো ব্যত্যয় হতে পারবে না। শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে সংসদের মেয়াদের সমাপ্তি হতে পারে। রাষ্ট্রপতির ভেঙে দেয়া ছাড়া সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের কম-বেশি করা সরকারের কিংবা আদালতের নেই। তবে প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকা কালে সংসদের আইন দ্বারা সংসদের মেয়াদ এক বছর বর্ধিত করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের সংবিধান যথাযথভাবে অনুসরণের বিষয়টি নিশ্চিত করণে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোনো ভূমিকা রাখছে না। সংসদের অভিভাবক স্পিকার। সংসদের সেই অভিভাবক নিজেই সংসদকে সুরক্ষা দিচ্ছেন না।
স্পিকার বিবেচনায় নিচ্ছেন না যে, সংসদের মেয়াদ খর্ব করা যায় না। সুতরাং দ্বাদশ সংসদের শপথ হওয়ার কথা ২৯শে জানুয়ারির পর।
আর সরকার ডামি নির্বাচনের পর দ্রুত শপথগ্রহণ করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে গিয়ে সংবিধানের নির্দেশনা পালন করা সরকারের কাছে জরুরি কর্তব্য মনে হয়নি। দু’টো সাংবিধানিক জটিলতায় বারবার সংসদের মেয়াদ কম-বেশি হচ্ছে। চলমান সংসদ থাকতে আরেক সংসদ গঠিত হচ্ছে এবং সরকারও গঠিত হচ্ছে। আর সর্বোচ্চ আদালত সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে দেখেও না দেখার অবস্থান গ্রহণ করছে। এতে এটা উপলব্ধি করতে খুব বেশি প্রজ্ঞাবান হওয়ার দরকার হয় না যে, আমরা প্রজাতন্ত্রকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর উপযুক্ত করে ফেলেছি।
‘একদিকে মেয়াদ সমাপ্তির আগে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ কার্যভার গ্রহণ করিবেন না বলা হয়েছে,
অন্যদিকে সংবিধানের ১৪৮ (২ক)তে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিতে বাধ্যতামূলক করেছে’। এসব চরম সাংঘর্ষিক অনুচ্ছেদ পরস্পর বিদ্যমান থাকায় সংবিধান লঙ্ঘনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক