মিয়ানমারে জান্তা হেরে যাচ্ছে, কিন্তু তারপর?

0
85

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী নেতারা যে কতটা প্রভাবশালী (এমনকি যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই, তাঁরাও), তা গণতন্ত্রের পক্ষে নিরন্তর কথা বলে যাওয়া লোকদের চিন্তারও বাইরে। এ-ই যখন অবস্থা, তখন মিয়ানমারে ব্যতিক্রম অবস্থা দেখা যাচ্ছে। সেখানকার প্রতাপশালী সামরিক জান্তাকে ক্ষমতাহীন হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।

জেনারেলদের হাতের মুঠোয় থাকা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎকে কণ্টকমুক্ত করতে এখন মিয়ানমারের লোকেরা জান বাজি রেখে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬২ সালে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর দেশটিতে সীমিত আকারে হলেও রাজনৈতিক উদারীকরণ, অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া ২০১১ সালে শুরু হয়ে তা ২০২১ সালে শেষ হয়।

মিয়ানমারের পুনর্নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের হাত থেকে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা ছিনিয়ে ফের সামরিক শাসন জারি করলে দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ সম্প্রদায়, জাতিভিত্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বেসামরিক নেতা-কর্মী এবং ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়েন।

অতি সম্প্রতি প্রতিরোধ বাহিনী তাঁদের সংগ্রামকে ‘বিপ্লব’ বলে দাবি করছেন এবং তাঁরা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে একের পর এক লড়াইয়ে সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করছেন। তবে কিনা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করা এক কথা আর জাতিগতভাবে শতধাবিভক্ত দেশটিতে একটি কার্যকর বহুত্ববাদী রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা আরেক কথা।

তবে মিয়ানমারের এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত মাসের পর মাস প্রলম্বিত হতে পারে। কারণ, সামরিক জান্তা তাদের সর্বশেষ ঘাঁটি রাজধানী নেপিডোর পতন ঠেকাতে রাজধানী ও তার চারপাশে পদাতিক, গোলন্দাজ ও বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করতে থাকবে। বর্তমানে জান্তা সরকারের অবস্থাকে যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সঙিন মনে হচ্ছে। জান্তার হাতে একসময় পাঁচ লাখ সেনার বিরাট বাহিনী ছিল। এখন সেই সংখ্যা দেড় লাখে নেমে এসেছে এবং এই সেনারাও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছেন।

বিশ্বের অন্যতম ঝানু সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রামরত জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে উঠে আসা মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে লড়াই করে আসছে। এত দিন তারা সফলভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এলেও এবার তারা ভুল লক্ষ্য বেছে নিয়েছে।

গৃহযুদ্ধে জয়লাভের পর বিরোধীরা যদি শান্তি নষ্ট করে, তাহলে সেটি লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এটি কেবল হতাশার দিকে পরিচালিত করবে না, এটি নতুন করে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি করবে এবং স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যগুলোতে মাদক পাচার ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ বাড়িয়ে দেবে।

অভ্যুত্থানের সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশব্যাপী বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারি সেনারা তাঁদের বন্দুকের নল সাধারণ মানুষের দিকে ঘুরিয়ে দেন। তাঁরা হাজার হাজার সাধারণ বর্মি নাগরিককে বাছবিচারহীনভাবে গুলি করে হত্যা করেছেন। এটি জনক্ষোভের আগুনকে ছড়িয়ে দিয়েছে।

বর্মি তরুণদের মধ্য থেকে প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃত্ব এসেছে। মিয়ানমারে যখন অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত ও উদার অবস্থা, অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাপনব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার পরিবেশ ছিল, মূলত সেই সময়ে বেড়ে ওঠা তরুণেরা এই জান্তাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

এই তরুণেরা দেশব্যাপী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) গঠন করে বিভিন্ন ইউনিটে সংগঠিত হয়েছেন। তাঁরা প্রথম দিকে বাড়িতে তৈরি অস্ত্র ও অন্যান্য প্রাথমিক অস্ত্র জোগাড় করেছিলেন। পরে তাঁরা জাতিগত মিলিশিয়াদের সঙ্গে (আগে যারা ‘এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনস’ নামে পরিচিত ছিল) গাঁটছড়া বেঁধেছেন এবং তঁাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

বেসামরিক নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি), এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনস (ইএওএস) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) সমন্বয় করে কাজ করছে। তাদের সমন্বিত স্কোয়াডগুলো শাসক বাহিনীকে ঘায়েল করতে গেরিলা কৌশলের পাশাপাশি প্রচলিত যুদ্ধকৌশলও অনুসরণ করছে।

অভ্যুত্থানের মাত্র এক বছর পরে যুদ্ধ অচলাবস্থায় পৌঁছেছিল। তবে সামরিক নৃশংসতা ও বর্বরতা জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণবিদ্রোহকে উসকে দেওয়ার পর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধযোদ্ধারা দ্রুত তঁাদের দখল বাড়াতে সক্ষম হন।

চারদিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে সেনাবাহিনী নতুন সদস্য নিয়োগ করার এবং শক্তি বাড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা তীব্র রসদ-সংকটে পড়েছে। এতে তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে।

মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, আ’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি—এই তিন সশস্ত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স মাস দুয়েক আগে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামের একটি অভিযান চালায়। এই অভিযানের পর উভয় পক্ষের জন্যই ‘কিছুতেই আর পিছু হটার উপায় নেই’ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

চীনের সঙ্গে লাগোয়া উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে তাদের সমন্বিত সাঁড়াশি অভিযানে জান্তা বাহিনীর কাছ থেকে দুই ডজন শহর এবং কয়েক শ সামরিক চৌকি হাতছাড়া হয়ে যায়।

অন্যান্য জাতিভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন এবং কায়াহ, চিন, রাখাইন ও কাচিন রাজ্যের প্রতিরোধশিবিরগুলোর সমন্বিত হামলা এবং ম্যাগওয়ে ও সাগাইং অঞ্চলের প্রতিরোধযোদ্ধাদের হামলা সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছে। অন্যদিকে এটি প্রতিরোধ শক্তির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। মনে হচ্ছে, জান্তার পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। তবে মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও স্বৈরাচারের পতনের পর জান্তাবিরোধী শক্তিগুলো যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

ইএওএস বা জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো নিজেদের এলাকায় নিজেরা ক্ষমতা ধরে রাখায় বিশ্বাসী। এই সংগঠনগুলো শুধু কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে হটানো প্রশ্নে একত্র হয়েছে। অন্যদিকে, পিডিএফ ইউনিটের হয়ে লড়াইরত তরুণদের সরকার ও জোট গঠনে অভিজ্ঞতা নেই। আবার এনইউজি এখনো একটি বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেনি।

গৃহযুদ্ধে জয়লাভের পর বিরোধীরা যদি শান্তি নষ্ট করে, তাহলে সেটি লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এটি কেবল হতাশার দিকে পরিচালিত করবে না, এটি নতুন করে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি করবে এবং স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যগুলোতে মাদক পাচার ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ বাড়িয়ে দেবে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশন (আসিয়ান) এ বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা নিয়ে এখনো বিভক্ত অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় আসিয়ানকে বিবদমান সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

সর্বোপরি, মিয়ানমারের স্বৈরতন্ত্রকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে হলে আঞ্চলিক শক্তি ও বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থপূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন।

থিতিনান পংসুধিরাক ব্যাংককের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here