শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ বেশ কিছু প্রধান রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়েই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। ফলাফল কী হবে তা অনেকটাই অনুমেয়। এখন ফলাফল ঘোষণার অপেক্ষা। একপেশে, বিরোধীদলবিহীন নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহ তেমন নেই। বরং এই নির্বাচন নানা ধরনের হাস্যরসে পরিণত হচ্ছে। ওইদিন দেখলাম একটি স্যাটায়ার ম্যাগাজিন মৃত ভোটাররা ভোট দিতে আসবেন, এরকম একটি প্যারোডি গান তৈরি করেছে। উল্লেখ্য ২০১৮ সালে অনেক মৃত ভোটারের নামে ভোট দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের জয় বাংলা গানের বিপরীতে বিএনপিপন্থীরা আর্থিক দুর্নীতি, লুটপাটের বিবরণ দিয়ে পাল্টা জয় বাংলা গান তৈরি করেছে। ভোটের মাঠের লড়াই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে বিরাজ করছে। দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান সঠিক বলে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
কিন্তু এই একপেশে নির্বাচন কেন হচ্ছে? এই পরিস্থিতি কি এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিসহ অন্যান্যদের দাবি মেনে নিলো না। অন্তত সংলাপেও বসলো না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে আমাদের নির্বাচন এখন আর আমাদের একান্ত নিজস্ব কোনো বিষয় না। আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। আমাদের নির্বাচনে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির ছায়া গভীরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। বড় বড় শক্তিগুলো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আমাদের নির্বাচন নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলা মানেই এর সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলো থাকবে। না থাকলে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে বলবে না অন্তত। বিপরীতে চীন, রাশিয়া ও ভারত পুরোপুরি আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে। রাশিয়া, চীন পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনীতিতে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ তারা মেনে নিবে না। রাশিয়া তো বলেই দিয়েছে নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব বসন্তের মতো কিছু একটা ঘটাতে পারে।
বরাবরই ভারত বলে এসেছে, বাংলাদেশের জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে। নিরপেক্ষ থাকার ভান ধরলেও এই একপেশে নির্বাচনী খেলার মূল নিয়ন্ত্রণকারী ভারতই। কারণ বাংলাদশে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের অবস্থান কৌশলগত। চীনের কিছুটা বাণিজ্যিক স্বার্থও আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বড় বাণিজ্যিক অংশীদার না। তাই তাদের স্বার্থ এখানে বিশ্ব রাজনীতির কৌশলগত দিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ কখনোই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বা ঝুঁকির কারণ হবে না। বরং বাংলাদেশে তাদের শক্তিশালী অবস্থান এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিবে।
কিন্তু ভারতের বাংলাদেশ নিয়ে নীতি কৌশল পুরোপুরিই নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থও আছে। কিন্তু ভারত তার নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার বিবেচনা করতে গিয়ে অতিমাত্রায় আওয়ামী লীগের মঙ্গে মাখামাখি সম্ভবত বিপাকেই ফেলে দিবে ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে। ভারত কখনোই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বন্ধু হতে পারেনি। সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিতে পারেনি। উজানে, পানি প্রত্যাহার, সীমান্তে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন সময় উস্কানিমূলক কথাবার্তা এবং একমাত্র আওয়ামী লীগকেই ভারতের মিত্র মনে করার প্রবণতা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবে প্রবলভাবে উস্কে দিয়েছে সব সময়। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার সূত্রে যতটুকু জানা যাচ্ছে, তা হলো ভারতের অনড় মনোভাবের জন্যই ৭ই জানুয়ারির একপেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
এর কিছু আভাস মিলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়। একপেশে নির্বাচনে আগে যখন নানা ধরনের কথা বাতাসে উড়ছিল তখন ওবায়দুল কাদের নিশ্চিত করেন, আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ভারত মেনে নিবে না। মানে ওবায়দুল কাদের ভারতকে মুরুব্বী হিসাবে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করলেন। তার মানে ভারত এখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে এটা সহজেই অনুমান করা যায়। কয়েকমাস আগে আওয়ামী লীগ সম্ভবত কিছুটা নমনীয় হতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপের কারণে। কিন্তু ভারতের বাধার কারণে পারেনি।
ভারত হয়তো মনে করছে, ঢাকায় ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগ সরে গেলে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ থাকলেও পুরোপুরি রক্ষা হবে না। কারণ এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা নিবিড়ভাবে বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটাই চীননির্ভর হয়ে পড়েছে পদ্মা সেতুর মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। এই নির্ভরতা দিন দিন বাড়বে। কারণ দেশে যেহেতু গণতন্ত্র নেই তাই জনসাধারণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে রাখতে বা প্রপাগাণ্ডা তৈরি করতে বৃহৎ আকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ দেখাতে হবে। কিন্তু এবার মনে হয় আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের সাম্যতা বজায় রাখা সহজ হবে না। যেমন চীনের রাষ্ট্রদূত কয়েকদিন আগেই বলেছেন, নির্বাচনের পরই তারা তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করবে। চীন তিস্তা নদীতে ব্যারেজ নির্মাণ, খনন করতে চায় এবং তিস্তার তীরে একটি টাউনশিপ তৈরি করতে চায়। ভারতের সীমান্তের কাছে চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না। চীন তিস্তা প্রকল্প ছাড়াও আরো নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে আসবে। চীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার সামরিক চুক্তিও করেছে। শুধু এসব প্রকল্পই না চীন বাংলাদেশকে রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টে (আরসিইপি) দেখতে চায়। এই এগ্রিমেন্টে ভারত নেই। ভবিষ্যতে এই আরসিইপি বাণিজ্যিক জোট থেকে সামরিক জোটে পরিণত হলে তখন ভারতে ঝুঁকি আরো বাড়বে। ভারত এখানে যা ভুল করছে তা হচ্ছে অতিমাত্রায় বিএনপি বিরোধীতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগ মনে করছে বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ কেবল তারাই রক্ষা করতে পারে। বাস্তবে তাই করছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। ভারতও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া আচরণ করছে। গত দুই নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা আমাদের তাই বুঝতে সহায়তা করে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীও তার আত্মজীবনীতে পরিস্কার করেই অনেক কিছু বলেছেন। কিন্তু ভারত বুঝতে পারছে না বাংলাদেশে মার্কিন উপস্থিতির থেকে চীনের শক্তিশালী অবস্থান তার নিরাপত্তার জন্য অধিক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের অজিত দোভালের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বিষয়ক দল লাদাখ সমস্যার সামাধান না করেই বাংলাদেশে চীনের গেড়ে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাও আবার অরুণাচলের কাছে। অথচ অরুণাচলকে কিছুদিন আগেই চীন এক মানচিত্রে নিজের অংশ বলে দেখিয়েছে।
ড. মারুফ মল্লিক
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[contact-form][contact-field label=”Name” type=”name” required=”true” /][contact-field label=”Email” type=”email” required=”true” /][contact-field label=”Website” type=”url” /][contact-field label=”Message” type=”textarea” /][/contact-form]