সাকিব আল হাসান ও নির্বাচন নিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদন

0
89

দেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। তার রেকর্ড, খেলায় তার অর্জন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন খুব কম মানুষই। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এ সময়ের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন সাকিব। এই ক্রিকেটার ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠেয় বিরোধীদলহীন ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তিনি এখনো বাংলাদেশ দলের সক্রিয় খেলোয়ার।

সম্প্রতি তিনি নির্বাচনের প্রচারনার উদ্দেশ্যে এক ইউটিউবার এবং টক-শো উপস্থাপককে সাকিব সাক্ষাতকার দিয়েছেন। মাগুরার এক অডিটরিয়ামে এই সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। অপেক্ষমান কয়েকশো লোকের সামনে দিয়ে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতো হাত নাড়িয়ে তিনি অডিটরিয়ামে প্রবেশ করেন।

সাক্ষাতকার শুরু হতেই, সাবিবকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা আলাদা কিছু জন্য বিখ্যাত, হয় খাবার, হয় গার্মেন্টস, নাহলে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে মাগুরায় কারো কাছে এর বিশেষত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সবাই একমুখে বলে: শাকিব আল হাসান।”

“হ্যাঁ, আমিও তাই বলতাম,” হাসান ঠাট্টার সুরে জবাব দিলেন। সাবিব হাসলেন, দর্শকরাও হাসল।

কিন্তু এই রসিকতাপূর্ণ জবাব সম্ভবত ৩৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারকে সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরে, যিনি মাঠের ভিতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই আক্রমণাত্মক আচরনের জন্য পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবেও খ্যাত, এটিও তার রসিকতাপূর্ণ উত্তরে প্রকাশ পায়।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে ক্রিকেট এবং সিনেমা হলো দুটি প্রধান নেশা। কিছু ক্রিকেটার সুপারস্টারে পরিণত হয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ ভক্তের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন। কিছু ক্রিকেটার তাদের জনপ্রিয়তাকে রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করেছেন, প্রাক্তন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেরা উদাহরণ। তবে সাকিব সঠিক সময়ে রাজনীতে আসেন নি বলে মনে করেন অনেকে ।

কারণ বাংলাদেশে যা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এইটাকে কি নির্বাচন বলা যাবে?

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভোট পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবাধয়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করার পরে বিরোধী দলগুলি নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেয়। হাসিনা ১৫ বছর ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে।

একদিকে নির্বাচনের আয়োজন। অন্যদিকে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের জেল বন্দি করছে। অনেকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে, যা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলা এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছ। মঙ্গলবার থেকে বিরোধী দলগুলি একটি নতুন তিন দিনের প্রচারণা শুরু করে, মানুষকে ভোটকেন্দ্রে না যেতে অনুরোধন করে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।

নির্বাচন যেভাবে হচ্ছে তাতে দেশের অনেকেই ক্ষুব্ধ । বিতর্কিত ঘটনার কারণে বাংলাদেশি ক্রিকেটের “খারাপ ছেলে” হিসেবে পরিচিত সাকিব, এই সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পাননি। তিনি মাগুরা থেকে দেশের সংসদে আসন লাভের চেষ্টা করছেন।

হাসানের এলাকার বিএনপির এক প্রবীণ রাজনীতিবিদ আলী আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আপনি কি এটিকে নির্বাচন বলছেন? এটা নির্বাচন নয়, এটা একটা নিয়োগ। এখনই হাসানকে সংসদ সদস্য ঘোষণা করে দিন এবং আমাদের এই লজ্জা থেকে বাঁচান।”

আল জাজিরার সাথে কথা বলেছেন এমন মাগুরার আরও অনেকেই আহমেদের হতাশাকে প্রতিধ্বনিত করেছেন। শহরটি যদিও বিরোধী দলের দুর্গ নয়, তবে দীর্ঘদিনের একনায়কত্বের অভিযোগ এবং মূল্যস্ফীতি ভোটারদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী মনোভাব আরও জোরালো করেছে।

মিষ্টির দোকানের মালিক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী আল জাজিরাকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ দল জাতীয় নির্বাচনের উৎসব থেকে মানুষকে বঞ্চিত করেছে।

তিনি আরও বলেন,“আমাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। গত দুটি নির্বাচন ছিল এক নাটক। আগামীটি আরও বেশি। এখানে সবাই জানেন যে শাকিব [আল হাসান] এমপি হবেন কারণ তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে কি কোনো গৌরব আছে?” ।

“এছাড়া, আমি মনে করি না যদি সঠিক নির্বাচন হতো তাহলেও সে জিতত। শাকিবের এখানে জনপ্রিয় নেই।”

রাজনীতিবিদ আহমেদ বলেন, “হাসান নিঃসন্দেহে মাগুরার ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি। মানুষ তাকে খেলোয়ার হিসাবে চিনে। খেলোয়াড় হিসেবে ছোট শহরটির নাম বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তিনি তার নিজ শহরের মানুষদের থেকে যতটা দূরে থাকতে পারেন, ততটাই দূরে আছেন। সে অহংকারী নব্য ধনীদের মতো আচরণ করে এবং শিষ্টাচারহীন। তার কোনো রাজনৈতিক পদ গ্রহণের যোগ্যতা নেই। আর এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, সম্ভবত তিনি তার জনপ্রিয়তার শেষ অংশটিও হারিয়ে ফেলেছেন।”

হাসানের চাচাতো ভাই এবং তার প্রচারণা পরিচালকদের একজন মেহেদি হাসান উজ্জ্বল দাবি করেন, মানুষজন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

“শাকিব যেখানেই যান, সেখানেই যে জনসমাগম হয় সেটা আপনারাই দেখতে পাচ্ছেন। এই মানুষজনের সমবেত হওয়া এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখেই বুঝতে পারা যায় তার কতটা জনপ্রিয় আছে।”

হাসানের দীর্ঘদিনের ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবদুল ফাহিম আল জাজিরাকে বলেন, হাসানকে মানুষ “ভুল বুঝে”। তারা মনে করে সে অহংকারী এবং জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। কিন্তু ফাহিম বলেন, হাসান আসলে খুবই সাধারণ এবং দক্ষ যোগাযোগকারী।

ফাহিম বলেন, ক্রিকেটারদের তাদের পারফরম্যান্সের ওপর মনোযোগ দেওয়ার জন্য জনসাধারণ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মানে এই নয় যে তারা জনসাধারণের দায়িত্ব ভালোভাবে চালাতে পারবে না। আসলে, তারা সাধারণ মানুষের মনোভাব অন্য অনেকের চেয়ে ভালো বুঝতে পারে।

কয়েকবার চেষ্টা করার পরও, হাসান আল জাজিরার সাথে কথা বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনি “বিদেশি মিডিয়াকে কোনো সাক্ষাত্কার দিতে চান না”।

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি আল জাজিরাকে বলেছেন, হাসান সম্ভবত হাসিনার আওয়ামী লীগের “সেরা প্রতিনিধিত্বকারী প্রার্থী”।

“গত এক দশকে আওয়ামী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলো অহংকার, অজ্ঞতা, মিথ্যা, এবং সাধারণ মানুষের চাহিদা ও দাবিকে গুরুত্ব না দেওয়া। শাকিবের চরিত্রে এইসবের নিখুঁত সমন্নয় আছে। ফলে তিনিই লীগের জন্য যোগ্য ”
আসন্ন নির্বাচনকে “বৃহৎ প্রহসন” বলে অভিহিত করে রনি বলেন, “যদি নির্বাচনের আগেই আপনি ফলাফল জানেন, কে জিতবে জানেন- তাহলে এটি ঠিক নির্বাচন নয়। খেলোয়ার ও সেলিব্রিটিদের এই নাটকে যোগদান ও প্রচারণা করতে দেখাটাও হতাশাজনক।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here