আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, ১৮ জন শতকোটির মালিক

0
115

এক মন্ত্রীর বিদেশে ২,৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের মধ্যে ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে ১৮ জনের। তাদের মধ্যে ১০ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত আর ৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এ ছাড়া কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে ২৭ শতাংশ হয়েছে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের দেয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে টিআইবি’র কার্যালয়ে ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শীর্ষক সম্মেলনে এই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। টিআইবি’র তৈরি করা নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র তুলে ধরেন এই গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। হলফনামায় তথ্য না দিলেও মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে বলে টিআইবি তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে ওই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি। সংস্থাটি জানিয়েছে, ওই মন্ত্রী বিদেশে থাকা এই ব্যবসার তথ্য তার হলফনামায় উল্লেখ করেননি।

টিআইবি’র প্রতিবেদনে দেখানো হয়, সর্বশেষ তিনটি ও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দ্বাদশ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। কোনো দলই তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেয়নি, তবে শতভাগ আসনেই কমপক্ষে এক বা অনেক ক্ষেত্রে একাধিক প্রার্থী হয় ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বা সমর্থনপুষ্ট। প্রার্থীদের অর্ধেকের বেশিই প্রায় ৫৭ শতাংশই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রার্থী স্বশিক্ষিত।

সর্বশেষ তিনটি ও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৫৭ শতাংশ ব্যবসায়ী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। গত ১৫ বছরে ব্যবসায়ী প্রার্থীদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রার্থী। এ ছাড়া আইন ও কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন যথাক্রমে ৯ এবং ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রার্থী। এর পরেই রয়েছেন চাকরি ও শিক্ষক পেশার প্রার্থীরা। রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রার্থী। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২ দশমিক ৭১ শতাংশ, চিকিৎসক ২ দশমিক ১৯ শতাংশ, সাংবাদিক ০ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং গৃহস্থালি ০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এদিকে বছরে ১ কোটি টাকা আয় করেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা এবার সর্বোচ্চ ১৬৪ জন। তবে কোটি টাকার কম আয় করে এমন প্রার্থীর হার ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এবার প্রায় ২৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে)। শত কোটিপতি প্রার্থী সংখ্যায় ১৮, সর্বোচ্চ কোটিপতির প্রদর্শিত সম্পদমূল্য ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বশেষ তিনটি ও আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক কোটিপতি প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। অর্থাৎ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোটিপতি প্রার্থীদের প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে নবম নির্বাচনে কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন মাত্র ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। সেটি ১৫ বছরের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। এদিকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা প্রার্থীদের প্রায় ৪৭ শতাংশই কোটিপতি। হলফনামায় আরও দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রার্থীর নামেই বড় আকারের (সর্বোচ্চ ৮১৩ একর) ভূমির মালিকানা রয়েছে। অথচ, দেশের আইন (ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্ট-২০২৩) অনুযায়ী একজন ব্যক্তির ভূমির মালিকানা পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (কৃষি জমির ক্ষেত্রে ৬০ বিঘা এবং অ-কৃষি জমিসহ যা ১০০ বিঘা পর্যন্ত যেতে পারে)।  এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রায় ২৭ শতাংশেই ঋণ বা দায় আছে। যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। হলফনামার তুলনামূলক হিসাবে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের কারও কারও আয় সর্বোচ্চ ২ হাজার শতাংশের বেশি বেড়েছে। ৫ বছরে এমপিদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আয় বৃদ্ধির হার ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ এবং ১৫ বছরে এই হার ৭ হাজার ১১৬ শতাংশ। একইভাবে, ৫ বছরে এমপিদের সর্বোচ্চ সম্পদ বৃদ্ধির হার ৫ হাজার ৪৭০ শতাংশ। ১৫ বছরে এই হার ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৩ শতাংশ। মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীদের ৫ বছরে আয় সর্বোচ্চ বেড়েছে ২ হাজার ১৩৪ শতাংশ, একই সময়ে ৫ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১ হাজার ৬৩ শতাংশ এবং ১৫ বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ।

পাঁচ বছরের ব্যবধানে আয় বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী:গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে আয় বেড়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির। এর পরেই রয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

পাঁচ বছরের ব্যবধানে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী: গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে সম্পদ বেড়েছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের। এর পরে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা হলেন- নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
হলফনামায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে মন্ত্রী ও এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, হলফনামায় উঠে আসা সকল তথ্যই সঠিক কিনা, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা যেভাবে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে হলফনামায় সম্পদের হিসাব প্রকাশ এক ধরনের দায়সারা গোছের আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। হলফনামায় মিথ্যা বা অপর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ করা, আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে যে সকল প্রতিষ্ঠানের এসব বিষয় খতিয়ে দেখার কথা, তারাও এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে, যে আয়, ঋণ ও সম্পদ অর্জনের তথ্য হলফনামায় প্রদান করা হয়েছে, বিশেষ করে যে রূপ অবিশ্বাস্য মাত্রায় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীগণের অনেকেরই সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তা বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং তা না হলে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ না থাকা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালনের যথেষ্ট সুযোগ ও অপরিহার্যতা রয়েছে। তাই টিআইবি’র ড্যাশ বোর্ড থেকে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দুদক, এনবিআর, নির্বাচন কমিশনসহ সকল অংশীজন তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করবেন- এই প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে, এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলসমূহের সামনে যে আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা দলসমূহের কাছে যথাযথ গুরুত্ব পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, তাদের কাছে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে। হলফনামায় তা দেখা যাচ্ছে না। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ওই মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে আবাসন নির্মাণ (রিয়েল স্টেট) ব্যবসা পরিচালনা করছে। সেগুলোর মূল্য ১৬ দশমিক ৬৪ কোটি পাউন্ড বা ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। ওই মন্ত্রী তার হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই মন্ত্রী ২০১০ সালে প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য ১ দশমিক ৭৩ কোটি পাউন্ড। এরপর ২০১৬ সালে আরেকটি কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য ৭ দশমিক ৩১ কোটি পাউন্ড। ২০১৯ সালে তৃতীয় কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য দশমিক ৭৯ কোটি পাউন্ড। তিনি ২০২০ সালে চতুর্থ কোম্পানি চালু করেন, যার সম্পদ মূল্য ২ দশমিক ১৫ কোটি পাউন্ড এবং ২০২১ সালে পঞ্চম ও ষষ্ঠ কোম্পানি খোলেন, যেগুলোর বর্তমান সম্পদ মূল্য ৩ দশমিক ২২ কোটি পাউন্ড।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নাম জানতে চাইলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু তথ্য গোপনের ব্যাপার রয়েছে এবং তিনি (মন্ত্রী) নিজে তা প্রকাশ করেননি। সে কারণে তার নাম প্রকাশ করা টিআইবি’র এখতিয়ারবহির্ভূত। তবে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ যদি টিআইবি’র কাছে তথ্যসূত্র জানতে চায়, তাহলে তারা তথ্যপ্রমাণসহ তা দেবেন।

টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, প্রার্থীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার খুবই ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে। আমরা দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারিনি। অথচ একটা শ্রেণি এতটাই সম্পদশালী হয়েছে যে, ভাবলে হতবিহ্বল হয়ে পড়তে হয়ে। অন্যদিকে একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী দিন-আনে-দিন খায় অবস্থাতেও নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো এটা না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যে রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করছে, তাদের সময়ই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম। গুটিকয়েক মানুষের উন্নয়ন হয়েছে- অথচ আমরা শুধু বলে বেড়াচ্ছি আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। অল্প সংখ্যক মানুষের আগ্রাসী ভূমিকার অধীনে আমরা চলে গিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই এই গুটিকয়েক মানুষ তাদের স্বার্থের বাইরে কাজ করছে না।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- টিআইবি’র উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলমসহ প্রমুখ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here