দেশে বিদায়ী বছরে ডেঙ্গুর সংক্রমণে মানুষ ব্যাপক আতঙ্কে ছিলেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা ছিল খুবই ঢিলেঢালা। অনেকটা লোক-দেখানো। ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ ২৪ জনের মৃত্যু হয় ১৫ই নভেম্বর। প্রায় ১৭শ’ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বিদায়ী বছরে। এক বছরে ৩ লাখ ২০ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু আসার পর এবছরই সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে দেশে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে বিদায়ী বছরের মৌসুমের আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠে। গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হয়। কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু এবং এর বাহক মশা সম্বন্ধে আমরা সবাই অবগত এবং এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আমাদের জানা।
বিদায়ী বছরে দেশে ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় শিরায় দেয়া স্যালাইনের সংকট দেখা দেয় সব জায়গায়। চাহিদার তুলনায় হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে পর্যাপ্ত স্যালাইন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা। হাসপাতালে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চাহিদামতো স্যালাইন দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ভারত থেকে স্যালাইন আমদানি শুরু করে সরকার। স্যালাইন সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায়। এজন্য দ্রুত ইডিসিএলের (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি) মাধ্যমে ৭ লাখ স্যালাইন ভারত থেকে আমদানি করার অনুমতি দেয় সরকার।
অবৈধ হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান: ২০২৩ সালে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো অবৈধ ও অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিরুনি অভিযান। দফায় দফায় সময় বেঁধে দিয়ে একাধিকবার এই অভিযান পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিদায়ী বছর দেশজুড়ে চলমান অভিযানে ১৬৪টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিমানা করা হয় ৪৯ লাখ ৫ হাজার টাকা। কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ৬ জনকে।
হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ: গত মার্চ-এপ্রিলে দেশে ডায়রিয়া বাড়তে শুরু করে। ফলে মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্রসহ (আইসিডিডিআর,বি’) অন্যান্য হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বাড়ে। সার্বিক অবস্থা মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ, দেশসেরা ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: স্বাস্থ্যসেবার মানদণ্ডে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে সর্বোচ্চ ৭৯ দশমিক ৯৮ স্কোর নিয়ে দেশের সেরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে মনোনীত হয় দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ ছাড়াও দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, যাদের স্কোর ৭৯ দশমিক ৫১। ১১ই নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ (হেলথ সিস্টেমস স্ট্রেংদেনিং-এইচএসএস) রেটিংসে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকাশিত স্কোরে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৭৯ দশমিক ৯৮ স্কোর নিয়ে দেশের সেরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে মনোনীত হয়েছে রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। একইসঙ্গে সারা দেশে দ্বিতীয় হয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে সর্বনিম্ন ১৫ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে তালিকার তলানিতে অবস্থান করছে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হেলথ সিস্টেমস স্ট্রেংদেনিং স্কোর তৈরিতে ১০টি সূচকে মোট ১০০ পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। মানসহ সূচকগুলো হলো- সেবা প্রদান, এই সূচকের মান ৭ দশমিক ২। এ ছাড়াও জনবল (সূচকের মান ৭ দশমিক ৬), স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য প্রদান (সূচকের মান ১৮ দশমিক ৬), প্রয়োজনীয় ঔষধ/যন্ত্রপাতি/ সেবা/অবকাঠামোগত সুবিধা (সূচকের মান ২ দশমিক ১৭), নেতৃত্ব/সুশাসন/ব্যবস্থাপনা (সূচকের মান ৩ দশমিক ৪৩)। এ ছাড়াও রয়েছে সেবা প্রাপ্তির সুযোগ (সূচকের মান ২০ দশমিক ৫), গুণগত সেবা প্রদান (সূচকের মান ১২), সেবার পরিধি (সূচকের মান ১২), নিরাপদ সেবা প্রদান (সূচকের মান ২ দশমিক ৫, এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষণ (সূচকের মান ১৪)।
এসেনসিয়াল ড্রাগে সরকারি অডিটে ৩২টি গুরুতর অনিয়মে ৪৭৭ কোটি টাকা লুটপাট: গত মার্চের ১১ তারিখে মানবজমিন পত্রিকায় এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর পর হৈচৈ লেগে যায়। হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগ্স কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি অডিটেই আর্থিক বড় দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদনে ৩২টি গুরুতর অনিয়মে সরকারি ৪৭৭ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার ৩৭৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। অনিয়মের মধ্যে ছিল-নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, ব্যবহৃত কাঁচামালের চেয়ে ওষুধ উৎপাদন কম দেখানো, উৎপাদিত ওষুধের সঠিক মাত্রায় কাঁচামাল ব্যবহার না করে গুণগত ওষুধ উৎপাদন না করা, কনডম প্রস্তুতে কাঁচামালের ঘাটতি, বনভোজনের নামে ভ্রমণভাতা, করোনাকালীন ক্যান্টিন বন্ধ থাকলেও প্রাপ্যতা না হওয়া সত্ত্বেও কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদেরকে অনিয়মিতভাবে ক্যান্টিনে সাব-সিডি প্রদানের নামে টাকা আত্মসাৎ। এ ছাড়া সর্বনিম্ন দরে মালামাল ক্রয় না করে উচ্চমূল্যে বিভিন্ন জিনিস ক্রয় করে সরকারি টাকার লুটপাট, সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ প্রদান না করে ভাগাভাগির মাধ্যমে সরবরাহকারীগণকে কার্যাদেশ প্রদান-পূর্বক মালামাল ক্রয় সংস্থার আর্থিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম উঠে নিরীক্ষায়।