বিএনপি’র নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও মুক্তির বিষয়ে দেয়া কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রোববার একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে ড. রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘এক রাতে সব নেতার মুক্তির প্রস্তাবেও রাজি হয়নি বিএনপি। দলটির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। যেটা করেছি আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি।’
তার এই বক্তব্য প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আসে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের তরফেও নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্যে দল এবং সরকারেও অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর ওপর ধরপাকড়, গ্রেপ্তার, মামলা ও সাজা দেয়ার বিষয়ে দেশ- বিদেশে সমালোচনা হচ্ছিল। কিন্তু সরকার এসবকে শুধুই আইনের বিষয় বলে এড়িয়ে আসছিল। কিন্তু ড. রাজ্জাকের এই বক্তব্যে বিরোধীদের দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সরকারি মহলেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
ড. রাজ্জাকের এই বক্তব্যকে তার ব্যক্তিগত মত উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ দেউলিয়া দল নয়। বিএনপি’র দাবির সুরেই ড. আব্দুর রাজ্জাক ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের যে তথ্য দিয়েছেন সে বিষয়ে অবশ্য ভিন্নমত প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, এটা আমরা স্বীকার করি না। ড. রাজ্জাক যে প্রস্তাবের কথা বলেছেন, এমন কোনো প্রস্তাব সরকার বিএনপিকে দেয়নি বলেও দাবি করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
ওদিকে আগের দিন দেয়া বক্তব্যে সামান্যতম ভুলও বলেননি বলে দাবি করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার দেয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন। বলেন, আমি যা বলিছি কোনো ভুল বলিনি। একদম ঠিক আছে।
ওদিকে ড. আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলেন, কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য প্রমাণ করে যে, মামলা-গ্রেপ্তার পরিকল্পিত। তিনি বলেন, সরকারের গুমর ফাঁস করে দিয়েছেন এই মন্ত্রী। এক প্রতিক্রিয়ায় জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিচার বিভাগের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিরোধীদের কারারুদ্ধ করার সরকারি পরিকল্পনা মন্ত্রীর এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
রাজ্জাকের বক্তব্য ব্যক্তিগত: কাদের
বিএনপি নির্বাচনে এলে দলটির কারাবন্দি নেতাদের এক রাতের মধ্যে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব সংক্রান্ত কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য দলের নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো দেউলিয়া দল নয়। আওয়ামী লীগ দলীয় নিয়মনীতি ভঙ্গ করে, এ ধরনের উদ্ভট প্রস্তাব বিএনপিকে দেবে, এটা সঠিক নয়। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আমাদের সরকার দেয়নি, দলও দেয়নি।
গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে দল কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, দলই সিদ্ধান্ত নেবে, কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা। আর কীভাবে ব্যবস্থা নেবে, সেটাও দলের ব্যাপার।
বিএনপি’র ২০ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমরা স্বীকার করি না। তাদের (বিএনপি) জেলে আছে কতো? হিসাবটা আমি মির্জা ফখরুল ইসলামের কাছে অনেকবার চেয়েছি। একটা উদ্ভট সংখ্যা বলে দিলো, সেটা সবাই বিশ্বাস করবে, এমন নয়। এত লোক গ্রেপ্তার হয়নি। আর যারা পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে, হাসপাতালে হামলা করেছে, তাদের তো আইনের আওতায় আসতেই হবে। কাউকে নির্বাচনে আনার জন্য অপরাধকে ক্ষমা করতে হবে- এমন দল আওয়ামী লীগ নয়।
আওয়ামী লীগের গোমর ফাঁস করেছেন আবদুর রাজ্জাক: রিজভী
সরকার পরিকল্পনা করে বিরোধী দলের ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে- এমন বক্তব্য দিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, কৃষিমন্ত্রীর এমন স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে বিএনপি’র মহাসমাবেশে তাণ্ডব-হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে চলমান যত সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তারসহ বিরোধীদলের বাড়ি-ঘরে হামলা-তল্লাশি সবকিছু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ব-পরিকল্পিত। সোমবার দুপুরে ভার্চ্যুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। রিজভী বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পূর্ণ মিথ্যা সাজানো মামলায় জেলে পুরে এবং সারা দেশে বাড়ি-ঘর ছাড়া করে তাড়িয়ে বেড়ানোর গোমর ফাঁস করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। রোববার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, সিট ভাগাভাগির উদ্ভট তামাশার নির্বাচনকে নির্বিঘ্ন-কণ্টকমুক্ত করার জন্যই বিএনপি’র ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমরা চিন্তা-ভাবনা করেই এই কাজ করেছি। তাদের জেলে না ভরলে দেশ অচল হয়ে যেতো। হরতালের দিন গাড়ি চলতো না।
ড. আবদুর রাজ্জাক আরও বলেছেন, ‘বিএনপিকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তারা নির্বাচনে এলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেয়া নয়, বলা হয়েছে, সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। এমনকি একরাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি রাজি হয়নি।
তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত এই প্রভাবশালী মন্ত্রী হাটে হাঁড়ি ভেঙে স্বীকার করলেন যে, দেশের আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন-কোর্ট কাচারি-বিচার-আচার সবকিছুই সরকারের হাতে বন্দি। বিচারব্যবস্থা আর আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গেছে। পৃথক কোনো সত্তা নেই। দেশে কোনো আইন নাই। সব শেখ হাসিনার ইশারাই চলছে। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও আইনের শাসনের আওয়ামী নমুনা কৃষিমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট হয়েছে। ২০ হাজার নির্দোষ নেতাকর্মীকে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করতে পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।