গ্রেফতার ও সাজার চাপে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা ফের চাঙা হয়েছে। শনিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ জেলা ও মহানগরের বিজয় র্যালিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই উপস্থিতি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছে। তাদের মনোবল আরও বেড়েছে। সরকার পদত্যাগের একদফা দাবি আদায়েও তারা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। তাই মাঠের আন্দোলন সামনে আরও কঠোর করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কাল মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি রয়েছে। পরের দুদিন আবারও অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। ২৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত একই ধরনের কর্মসূচি পালনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
একই সঙ্গে আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভোটারদের কাছে ‘আগ্রহহীন’ করতে চায় বিএনপি। এজন্য দুটি কৌশল গ্রহণ করেছে দলটি। একটি হচ্ছে রাজপথের আন্দোলন আরও জোরদার করা এবং অপরটি নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরা। ভোটদান থেকে জনগণকে বিরত রাখার বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে কয়েক দফা বৈঠক করছেন সিনিয়র নেতারা। সেখানে লিফলেট বিতরণসহ কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। তারা আরও জানান, গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে নেতাকর্মীরা নিজ বাসায় থাকতে পারছেন না। মহাসচিবসহ অনেক নেতাকর্মী কারাগারে। সাজা দেওয়া হয়েছে এক হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ করে রাজধানীর বিজয় র্যালিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি তাদেরও প্রত্যাশায় ছিল না। সেখানে সাধারণ জনগণেরও অংশগ্রহণ ছিল অনেক। এটি মূলত নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। গ্রেফতার, হামলা-মামলা ও সাজা দিয়ে আন্দোলন দমানো যায় না, যার প্রমাণ বিজয় র্যালিতে নেতাকর্মীরা দেখিয়েছেন। এতে এখন সারা দেশের নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছেও বার্তা দিতে পেরেছে বিএনপির আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। সূত্রমতে, ঢাকা মহানগরের বিজয় র্যালিতে আশপাশের জেলার নেতাকর্মীরাও অংশ নেন। আগামী দিনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তা সফল করতে তাদের রাজধানীতে অবস্থান করতে বলা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটা আদর্শিক লড়াই করছি। জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এই লড়াই। বিএনপি নেতাকর্মীরা সেই আদর্শের প্রতি ঐক্যবদ্ধ। এত হামলা, মামলা, নিপীড়নের পরও নেতাকর্মীরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নেতাকর্মীরা আজ ঘরে থাকতে পারছে না, তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারপরও সবাই কিন্তু আজ এক হয়ে আছে। তার কারণ জনগণের একটা বিরাট শক্তির সমর্থন রয়েছে বিএনপির আন্দোলনে। সবাই পরিবর্তন চায়। সামনে আন্দোলন আরও জোরদার হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই দাবি আদায় করবে বিএনপি।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রোববার (গতকাল) পর্যন্ত ২১ হাজার ৮৩৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। মামলা হয়েছে ৬২৫টির অধিক। মৃত্যু হয়েছে একজন সাংবাদিকসহ ২২ জনের। সারা দেশে এক হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীর বাড়িতে পর্যন্ত হামলা হয়েছে। গণগ্রেফতার চলছে। এতকিছু করার পরও বিজয় র্যালিতে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের স্রোত ঠেকানো যায়নি। আগামী দিনের কর্মসূচি আরও তীব্র হবে। সরকারের পতন নিশ্চিত করেই সবাই ঘরে ফিরবে।’
ঢাকা মহানগরে বিজয় র্যালি সফলের জন্য উত্তর ও দক্ষিণের অন্তত দশ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাও দায়িত্বে ছিলেন। একাধিক নেতা জানান, বিজয় র্যালিতে সুশৃঙ্খলভাবে নেতাকর্মীরা অংশ নেন। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের জেলার নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে র্যালি সফল করেছেন। তবে এত নেতাকর্মী হবে তা তারা ভাবেননি। এমনকি র্যালি শেষ করার পর নয়াপল্টন এলাকায় দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও তাদের বলেছেন, এতকিছুর পরও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি তাদেরও হতবাক করেছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, দশ দিন ধরে সব সাংগঠনিক জেলার পর সাবেক সংসদ সদস্য ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গেও ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সেখানে মূল বার্তাই ছিল, বিএনপির জন্য এই আন্দোলন বাঁচা-মরার লড়াই। এ লড়াইয়ে হারলে কেউ রেহাই পাবে না। তাই দ্বন্দ্ব ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে মাঠে থাকতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ জেলা ও মহানগরের বিজয় র্যালিতে এর প্রতিফলন দেখা গেছে। স্থানীয় রাজনীতিতে যাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, তারাও একই ব্যানারে পাশাপাশি ছিলেন।
এদিকে বিএনপির শোডাউনে স্বস্তিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও। অন্তত দশটি দলের শীর্ষ নেতা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে শনিবার বিজয় র্যালিতে বিএনপির শোডাউন রাজনীতির গতি পালটে দিয়েছে। গ্রেফতার, মামলা, হামলার কারণে অনেকটা কোণঠাসা ছিল বিএনপিসহ সমমনারা। আন্দোলনে নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবে কিনা বা কী হবে-এমন নানা প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে বিএনপির রাজধানীর বিজয় র্যালি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘সরকারের মামলা-হামলা, দমন-নিপীড়নের মধ্যেও ফ্যাসিস্ট ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির র্যালিতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। এর কারণ এটা জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অমানবিক নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দমন-নিপীড়ন করে মানুষের প্রতিবাদকে যে বন্ধ করা যায় না বিজয় র্যালিতে জনতার ঢল তারই বহিঃপ্রকাশ। বিএনপির র্যালি মানুষের মধ্যে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করবে। সেই সঙ্গে গণআন্দোলন যে নতুনভাবে পুনর্গঠন হয়েছে সেখানে ভিন্ন একটা মাত্রা যুক্ত করবে।’