নাজমুল আহসান, ইউরো এশিয়া
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে শতাধিক নির্দলসহ ২৯টি দলের ২২৬০ জন প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। তবে এই প্রার্থীদের কারোরই প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) -এর মতো আওয়ামী লীগ এবং এর ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার ক্ষমতা নেই। বিএনপি বিশ্বাস করে যে, যদি হাসিনা সরকার পদত্যাগ না করে এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে রাজি না হয় তাহলে আগামী মাসের ভোটাভুটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যাবে। হাসিনা পদত্যাগে রাজি না হওয়ায় ৩০ নভেম্বর বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। এ কারণেই অনেকে ইতিমধ্যে ভোটের ফলাফল জানেন। এখানে অন্যান্য ১০ টি কারণ তুলে ধরা হলো যাতে এটা স্পষ্ট কেন নির্বাচনের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত:
১. আট বছর বিরোধী দলে থাকার পর, আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুবিধা পেয়েও তিনি এখন পদত্যাগ করতে এবং সেই পথে যেতে অস্বীকার করছেন ।
২. সেই নির্বাচনে জয়লাভের দুই বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিধানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আংশিক রায়ের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিলো।
৩.পরবর্তী দুটি নির্বাচন তাই হাসিনা প্রশাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেগুলি অত্যন্ত বিতর্কিত হয়েছে। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল, যা আওয়ামী লীগকে আবার সরকারে ফিরে আসার সুযোগ করে দেয় ।
৪. তবে, বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, এমনকি এটি হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও।
অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে আশ্চর্যজনকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট বিশাল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করেছে, ৯৫% সংসদীয় আসন জিতেছে–যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভোটারদের ভয় দেখানো এবং নির্বাচনী জালিয়াতির ব্যাপক অভিযোগ তুলে।
৫. অনেক মানবাধিকার গ্রুপ মনে করে, টানা তিন মেয়াদে বা আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের সরকারে- দল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের ক্ষমতায় থাকার পথ প্রশস্ত করেছেন উদার গণতান্ত্রিক নীতির মূল্যে।
৬. হাসিনার শাসনামলে, আন্তর্জাতিক গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা রিপোর্ট করেছে।
৭. ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য সরকারকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে বিরোধী দল বিএনপি কখনও কখনও বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ সংঘটিত করেছে। বিক্ষোভ, দেশব্যাপী ধর্মঘট, পরিবহন অবরোধ কখনও কখনও মারাত্মক সহিংসতায় পরিণত হয়েছে।
৮. স্থানীয় মিডিয়া এবং বিএনপি জানিয়েছে, সরকার শুধুমাত্র ২৮ অক্টোবর থেকে গণগ্রেফতারের মাধ্যমে ২০ হাজারেরও বেশি বিরোধী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বিরোধী নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করছে । চাপ ক্রমেই বাড়ছে। গত ৩০ নভেম্বর বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়।
৯. নির্বাচনী সিস্টেমে গন্ডগোল শুরু হয় যখন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ১৫ ডিসেম্বর ঘোষণা করে যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২২৬০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৭০০ জনেরও বেশি নিজেদেরকে নির্দল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই তথাকথিত নির্দলীয় বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সদস্য যারা তাদের দলের আনুষ্ঠানিক প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
১০. নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য ১২ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন-১৮ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারী নির্বাচনের দিন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণার সাথে সম্পর্কিত নয় এমন সমস্ত জনসমাগম এবং সমাবেশে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেয়। বিএনপির বিক্ষোভ প্রতিরোধের লক্ষ্যে অনেক সমালোচক এই পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছেন।
নির্বাচন আদপে ‘একটি মঞ্চস্থ নাটক’
আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বাংলাদেশিরা ভালো করেই জানেন। বেনারনিউজ বাংলাদেশের ৩৪ জন ভোটারের কাছে আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা জানার জন্য যোগাযোগ করে এবং অর্ধেকেরও কম ভোটার এবিষয়ে কথা রাজি হয়েছেন।ঢাকা স্টেট কলেজের ছাত্র মোসলেহ উদ্দিন বিজয় বেনারনিউজকে নিজের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছেন, ”সাধারণ নির্বাচন আগে হতো উৎসবের মতো। এখন এটাকে কখনই নির্বাচন বলা যাবে না। এটি শুধুমাত্র সরকারের নতুন মেয়াদের নবায়নকে রাবার-স্ট্যাম্প দেয়ার প্রক্রিয়া মাত্র। এটি একটি মঞ্চস্থ নাটক।”
৫৫ বছর বয়সী ঢাকার নিরাপত্তাকর্মী নান্টু হাওলাদার রানার মতে, আসন্ন নির্বাচনে যা হতে চলেছে তা প্রায় সবার জানা। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বেনারনিউজকে বলেন, “এখন আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক মনোনীত প্রার্থীরা আওয়ামী লীগেরই নির্দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এটা কি এমনই হওয়ার কথা? আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক- তবে সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচন হওয়া উচিত।” রানার মতো আওয়ামী লীগের অন্যান্য সমর্থকরাও বেনারনিউজকে বলেন, সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে তাদের ভোট দেয়ার কোনো মানে নেই। বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারী অলক কুমার সরকার বলছেন -” আমি এবং আমার পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে নৌকায় [আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক] ভোট দিয়ে আসছি। কিন্তু মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের আমাদের মতো ভোটারদের আর প্রয়োজন নেই। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন তারা যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ জানে কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয় । তারা এখন বিরোধী দলকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে বিষয়টিকে কঠিন করে তুলতে চাইবে না। ”
ঢাকা থেকে রিপোর্টটিতে কনট্রিবিউট করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী এবং অয়ন আমান