অর্থ পাচারের ধরনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী তৎপরতায় বাণিজ্যের আড়ালে পণ্যের দাম কম বা বেশি দেখিয়ে অর্থাৎ ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাচার আগের চেয়ে কমেছে। এখন হুন্ডি এবং অনলাইন গেমিং-বেটিং ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্যমতে, বর্তমানে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের পাশাপাশি ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ অনলাইনে অবৈধ লেনদেন, ডিজিটাল হুন্ডি অনেক বেশি বেড়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর তৎপরতা বাড়াতে তাদের নির্দেশনাও দিয়েছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডিতে বেশি টাকা আসছে। পাশাপাশি সম্প্রতি অনলাইন গেমিং-বেটিংয়ে ফরেন কারেন্সি ঢুকে পড়ছে। এটা গ্রামগঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের কৃষকরাও এ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছে। অনেকে বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে বেশি বেশি ডলার মজুত করে রেখেছেন। তারা মনে করছেন, সামনে ডলারের দাম আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে অর্থ পাচারের ধরনে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।
বিএফআইইউর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএফআইইউ অনলাইন গেমিং ও বেটিং-সংশ্লিষ্ট ৩৭১টি, অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং-সংশ্লিষ্ট ৯১টি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি-সংশ্লিষ্ট ৪১৩টি সন্দেহজনক লেনদেন গ্রহণ করেছে, যা পর্যালোচনা করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া হুন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ২১টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ৩৯টি হিসাবের তথ্য অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়েছে। অনলাইন জুয়া বা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ৭২৫টি ব্যক্তিগত হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। অবৈধ হুন্ডি, গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টো-সংক্রান্ত মোট ৮১৪টি ওয়েবসাইট, ১৫৯টি অ্যাপ এবং ৪৪২টি সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ/লিঙ্ক (ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম) চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরবরাহ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি দেশে বা বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি ব্যক্তি কর্তৃক অনলাইন বেটিং বা জুয়া, ক্রিপ্টোকারেন্সি, ফরেক্স ট্রেডিং ও পঞ্জি স্কিম এবং এ জাতীয় অ্যাপস ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রায় আর্থিক লেনদেন ও বিনিয়োগের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ।
এদিকে বিএফআইইউ জানিয়েছে, দেশে বিভিন্ন পঞ্জি স্কিম বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার নজির দেখা গেছে। সম্প্রতি অনপেসিভ নামক অনুরূপ একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি বিএফআইইউর নজরে এসেছে। অনপেসিভ নামক এ পঞ্জি স্কিমে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন। এসব বিষয়ে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বেশ কয়েক দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা জনসাধারণকে এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যাচ্ছি। কারণ এ ধরনের কার্যক্রম আইনসিদ্ধ নয়। জনসাধারণ সচেতন হলেই এসব বন্ধ হবে।’
এদিকে বিএফআইইউর দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বেশি আসায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে গেছে। আর মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) কারণে হুন্ডির সুযোগ বেড়েছে। অর্থাৎ এমএফএসের মাধ্যমে হুন্ডি খুব সহজ হয়ে গেছে। হুন্ডির পাশাপাশি অনলাইন গেমিং-বেটিং ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেনেও এমএফএস প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই এসব লেনদেন হয়। তাই এসব মাধ্যমে অর্থ পাচার ও অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে আরও সতর্ক থাকার জন্য কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে বিএফআইইউ। এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন প্যারামিটার (পরিমাত্রা) দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা হুন্ডি বা গেমিং, বেটিং বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, সেটা পরিমাপ করতে পারবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে এই পাচার অব্যাহত থাকবে। এই পাচারের তালিকায় রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতির মাধ্যমে যারা অনেক অর্থ উপার্জন করেছেন, তারাও রয়েছেন। তারা নির্বাচনী অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে এই টাকা পাচার করছেন, নির্বাচনের পরে তাকে সেখানে চলে যেতে হলে যেন কোনো সমস্যা না হয়।
অনলাইন গেমিং, বেটিং এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের লেনদেন কোনোভাবেই আমাদের দেশে কাম্য নয়। তাই সরকারকে আইন করে এটা এখনই বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
অর্থ পাচারের ধরনে পরিবর্তন বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, এখনো বাণিজ্যের আড়ালেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচারের সিংহভাগ এ মাধ্যমেই হচ্ছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী মহল। আমাদের দেশে যেহেতু ব্যবসা এবং রাজনীতি মিলেমিশে একাকার, আর যারা বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করছে রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের দখলে। ফলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। হয়তো এ বিষয়টিকে হালকা করার জন্য অর্থ পাচারের ধরনে পরিবর্তনের বিষয়টিকে সামনে আনা হচ্ছে।
হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টিও নতুন নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটিও অনেক পুরোনো মাধ্যম। সম্প্রতি এই মাধ্যমে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি অর্থ পাচারে অনলাইন গেমিং, বেটিং এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু সেগুলো কেন করা হচ্ছে না, সেটিই বড় প্রশ্ন।
অর্থ পাচারের ধরন বিষয়ে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় দেশে কার্যরত ব্যাংকগুলোর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি করে অর্থ পাচার, বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং, ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সচেতন থাকার নির্দেশনাসহ দুষ্কৃতকারী ও অর্থ পাচারকারীরা যাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে কোনো অপরাধ সংঘটিত করতে না পারে, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান তিনি।
বিএফআইইউ আর্থিক অপরাধের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেবে উল্লেখ করে মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, যাদের পরিপালন ব্যবস্থায় দুর্বলতা পরিলক্ষিত হবে, তাদের বিষয়েই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কোনো আর্থিক অপরাধের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ব্যক্তি পর্যায়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।