বায়ু গুহা

0
112

হারুকি মুরাকামি

হারুকি মুরাকামি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক। মুরাকামির এই গল্পটি ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাহিত্য পত্রিকা ‘দ্যা নিউ ইয়র্কার’এ প্রকাশিত হয়েছিলো। যার ইংরেজি শিরোনাম ছিল ‘দি উইন্ড কেভ’। এখানে জবানের পাঠকদের জন্য গল্পটি অনুবাদ করা হয়েছে।

আমার বয়স যখন পনেরো, তখন আমার ছোট বোন মারা যায়। এটা হঠাৎ করেই ঘটেছিল। তার বয়স যখন মাত্র বারো, তখন সে জুনিয়র হাই এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল। সে জন্মগ্রহণ করেছিল হৃদরোগ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। প্রথমিক স্কুলের আপার গ্রেডে পড়ার সময় তার সর্বশেষ কিছু সার্জারি হয়েছিল। তখন তার তেমন কোন উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায় নি।তাই আমাদের পরিবার তার জীবনের ব্যাপারে কিছুটা ধূসর আশা নিয়ে নিয়ে নিশ্চিত ছিল । কিন্তু সেই বছরের মে মাসে তার হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হওয়া শুরু করল। যখন সে শুয়ে থাকত, আরো বেশি খারাপ হতো। অনেক নির্ঘুম যন্ত্রণাময় রাত কাটাতে হতো তাকে। ইউনিভার্সিটি হসপিটালে তার যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হোক না কেন, চিকিৎসকরা কখনোই তার দৈহিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন চিহ্নিত করতে পারতেন না।

কষ্টদায়ক ব্যয়াম এড়িয়ে চলতে হবে এবং রেগুলার রুটিন অনুসরণ করতে হবে,তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে -তার চিকিৎসক বললেন। আর এটাই সম্ভবত তার বলার ছিল।তিনি কিছু প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন।

কিন্তু তার arrhythmia স্বাভাবিক হলো না।খাবার টেবিলে আমি যখন তার মুখোমুখি বসতাম প্রায়ই তার বুকের দিকে তাকাতাম এবং ভাবতাম তার হার্ট এটার ভিতরেই আছে। তার স্তন যুগল লক্ষণীয় ভাবে বাড়তে শুরু করলো। আমার বোনের বক্ষসহ হৃদপিন্ডটা ছিল ত্রুটিযুক্ত এবং এমনকি কোনো বিশেষজ্ঞও তার ত্রুটি নির্ণয় করতে পারলেন না। আমি আমার শৈশব পার করেছিলাম এক ধরনের দুশ্চিন্তা আর ভয়ের মধ্য দিয়ে। কখন জানি আমি আমার ছোট বোনটাকে হারিয়ে ফেলি।

আমার বাবা মা আমাকে তার দিকে নজড় রাখতে বললেন,যেহেতু তার দেহ ছিল একেবারেই নাজুক।একই প্রধমিক স্কুলে পড়ার সময় আমি তাকে চোখে চোখে রাখতাম। যদি প্রয়োজন হতো, তাকে এবং তার ছোট হৃদপিন্ড টাকে রক্ষা করার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকতাম। কিন্তু সেই সুযোগ কখনোই আসে নি।

আমার বোনের মৃত্যু একধরনের প্রভাব ফেলল আমার উপর। এটা পরিণত হলো ক্লাস্ট্রোফোবিয়া বা আবদ্ধতাভীতিতে। যেহেতু আমি দেখেছিলাম তাকে একটি আবদ্ধ ছোট কফিনে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে এবং খুব ভালোভাবে বন্ধ করে দাহ করার জন্য নিয়ে যেতে, তাই আমি কোনো আবদ্ধ জায়গায় যেতে পারতাম না।

একদিন তার স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে সে পড়ে গেলো। সেইবু সিনজুকু স্টেশনের সিড়িতে উঠার সময় সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। দ্রুতই তাকে এম্বুলেন্সে করে একেবারে কাছেই এমার্জেন্সিতে নেয়া হলো। শুনামাত্রই হাসপাতালে ছুটে গেলাম,কিন্তু ততক্ষণে তার হৃদস্পন্দন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছুই চোখের পলকে ঘটলো। সেইদিন সকালে আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করেছিলাম। আমরা একজন আরেকজনকে বিদায় জানালাম, আমি চলে গেলাম হাই স্কুলে আর সে জুনিয়র হাইতে। পরবর্তী সময়ে আমি তাকে যখন দেখলাম যখন তার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ। তার বড় বড় চোখ গুলো বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে।তার মুখ কিছুটা উন্মুক্ত ছিল যেন সে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে আমি তাকে দেখলাম কফিনের ভিতর।পড়নে ছিলো তার প্রিয় কালো মখমলের পোষাক,কিছুটা হালকা সাজসজ্জা এবং তার চুলগুলো ছিলো পরিপাটিভাবে আচড়ানো। তার পায়ে ছিল চামড়ার কালো প্যাটেন্টের জুতো।তাকে খুব বিনীত ভাবে কফিনে শুয়ানো হলো। তার পোষাকের ছিল একটি সাদা কালারের লেন্স, এত সাদা যা দেখতে অস্বাভাবিক লাগছিল।

কফিনে শায়িত থাকাকালীন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল- সে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছিল তাকে হালকা ঝাকুনি দিলেই সে জেগে যাবে।কিন্তু সেটা ছিল শুধুই বিভ্রম। যতভাবেই তাকে ঝাকানো হোক না কেন, সে আর কখনোই জেগে উঠবে না।

আমি কখনোই চাই নি যে আমার ছোট বোনের কচি দেহটাকে একটা আবদ্ধ বক্সে আটকে রাখা হোক। আমি ভাবতাম তার দেহটাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা উচিত ছিল একটি খোলামেলা প্রশস্ত জায়গায়, সবুজ ঘাসের উপর। যেখানে ঘাষের উপর বাতাস প্রবাহিত হবে ধীর গতিতে, এবং পাখিরা পোকামাকড়েরা শব্দ করতে থাকবে তার চারপাশে। বুনোফুলের কাঁচা গন্ধে বাতাসের চারিদিক পূর্ণ হয়ে উঠবে। রাতের আকাশ ছেয়ে যাবে অসংখ্য রূপালী তারায়। সকালে সূর্যের আলোয় ঘাসের উপর শিশির বিন্দু দ্যুতি ছড়াবে ঠিক মুক্তোর মতো। কিন্তু আসলে এসবের বদলে, তাকে ভালোভাবে মুড়িয়ে রাখা হলো কফিনে।তার কফিনের চারপাশে কিছু অশুভ সাদা ফুল কাঁচি দিয়ে কেটে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই সংকীর্ণ কক্ষ হালকা আলো আর রঙ দ্বারা সজ্জিত ছিল। কৃত্রিম বিষাদ সুর ভেসে আসলো সিলিং এ লাগানো ছোট মাইক থেকে।

আমি তাকে দাহ করা সহ্য করতে পারছিলাম না। তার কফিনের ঢাকনা আটকে দেয়ার সাথে সাথে আমি কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলাম। যখন আমার পরিবার প্রথামতো তার হাড়গুলো ভষ্মাধারে রাখলো আমি কোনো রকম সাহায্য করিনি তাদের। আমি শ্মশানের চত্বরে ছুটে গেলাম আর নিঃশব্দে কান্না করলাম। একটা চিন্তাই আমাকে গভীরভাবে আহত করছিল যে- তার এই সংক্ষিপ্ত জিবনে আমি আমার ছোট বোনকে একবারের জন্যও সাহায্য করতে পারলাম না।

আমার বোনের মৃত্যুর পর আমাদের পরিবারে পরিবর্তন আসলো। আমার বাবা হয়ে গেলেন একেবারেই মৌনস্বভাবের এবং মা হয়ে গেলেন অনেক বেশী বদমেজাজি আর অস্থির।

কিন্তু, আমি আমার সেই জিবনেই রয়ে গেলাম, আগের মতোই থাকলাম। আমি অংশগ্রহণ করলাম স্কুলের মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে যা আমাকে সবসময়ই ব্যস্ত রাখতো। যখন সেটা থাকতো না, আমি তৈলচিত্র অংকন করতাম। আমার চিত্র শিক্ষক পরামর্শ দিলেন যাতে আমি একজন ভালো অধ্যাপক খুঁজি এবং পেইন্টিং নিয়ে অধ্যয়ন করি এবং যখন আমি আর্ট ক্লাসে যাওয়া শুরু করলাম। আমার আগ্রহ আরও গভীর রূপ নিতে থাকে । আমি নিজেকে প্রচুর ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করতাম, যাতে আমি আমার মৃত বোনকে ভুলে থাকতে পারি।

দীর্ঘ সময়- আমি ঠিক নিশ্চিত না কত বছর —- আমার বাবা মা ছোটবোনের রুমটা যেমন ছিল ঠিক তেমনি রাখলেন। তার টেবিলের উপর স্তুপাকারে রাখা ছিল টেক্সটবুক এবং স্টাডি গাইড, কলম, ইরেজার এবং পেপার ক্লিপ ;তার বিছানার উপর ছিল চাদর, কম্বল,এবং বালিশ ;তার ভাজ করা পাজামাগুলো, তার জুনিয়র হাই স্কুলের ইউনিফর্ম আলমারির ভিতর ঝুলন্ত—সবই অস্পর্শিত। দেয়ালের ক্যালেন্ডারে এখনো তার শিডিউল নোট করা আছে। তার মৃত্যুর মাসেই যেন থমকে আছে সময়। মনে হয় যেন দরজা খোলে যাবে যে কোন মুহূর্তে এবং সে বের হয়ে আসবে।

যখন কেউ বাসায় থাকতো না, আমি মাঝেমধ্যেই তার রুমে যেতাম এবং শান্ত ভাবে তার বিছানায় বসতাম এবং চারপাশে তাকাতাম। কিন্তু কখনোই কিছু স্পর্শ করতাম না। আমি বিরক্ত করতে চাইতাম না কোনকিছুকে,এমন কি ক্ষুদ্র, যে কোনো নীরব কোনো কিছুকেও বিরক্ত করতাম না। যেন সব কিছুই সংকেত প্রদান করত যে একসময় এখানে আমার বোন জীবিত বসবাস করতো।

আমি প্রায়ই কল্পনা করতে চেষ্টা করতাম কী হতো আমার ছোট বোনের জীবনে যদি সে বারো বছর বয়সে মারা না যেতো। যদিও আমার জানার কোনো উপায় ছিল না। এমনকি আমার জিবন কি রকম হতো সেই ছবিও আমি আঁকতে পারি না, সেই হিসেবে তার ভবিষৎ কেমন হতো সেই ধারণাও আমার ছিল না। তবে আমি এটা জানতাম যে যদি তার কোনো হার্টের ভাল্ব সংক্রান্ত কোনো সমস্যা না থাকতো তবে সে আকর্ষণীয় হিসেবে বেড়ে উঠতো। আমি নিশ্চিত অনেক পুরুষ তাকে ভালোবাসতো এবং তাদের বাহুডোরে তাকে পেতে চাইতো। কিন্তু আমি সেসব বিস্তারিত বর্ণনা করতে পারব না। আমার কাছে সে চিরকালই আমার ছোট বোন, তিন বছরের ছোট,যাকে আমার সুরক্ষা দেয়ার দরকার ছিল।

তার মারা য়াওয়ার পর, আমি তার একের পর এক স্কেচ আঁকলাম। আমার স্মৃতিতে তার যে চেহারা ছিল তা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্কেচ করে একটা স্কেচবুক বের করলাম। ফলে আমি আর তাকে ভুলে থাকতে পারতাম না। এমন না যে, আমি তার চেহারা ভুলতে বসেছি। এটা আমার মনে আজীবন গেঁথে থাকবে আমার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। আর এই জন্যই আমি এটাকে একটা আকৃতি দিয়েছিলাম অংকনের মাধ্যমে। আমার বয়স তখন মাত্র পনেরো ছিল এবং আমার এতসব জানা ছিল না- স্মৃতিশক্তি, অঁকাঅঁকি এবং সময়ের গতি সম্পর্কে। কিন্তু একটা জিনিস আমি জানতাম আর তা হলো আমার এমন একটা কিছু করা দরকার ছিলো যাতে একেবারে সঠিক তথ্য আমি আমার স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারি। কথায় আছে, কোন কিছু ত্যাগ করো এবংএটা অদৃশ্য হয়ে যাবে কোথাও। অনেকটো চোখেল আড়াল মানে মনের আড়াল টাইপের ব্যাপার। এটা কোনো বিষয় না স্মৃতি যতই দৃশ্যমান হোক না কেন, সময়ের ক্ষমতা অনেক বেশি শক্তিশালী। আমি তা জানতাম সহজাত ভাবেই।

আমি তার বিছানার উপর তার রুমে একাকী বসে থাকতাম। আমার মনের চোখে তাকে যে রকম লাগতো সেভাবেই আমি চেষ্টা করতাম সাদা কাগজে ফুটিয়ে তোলতে। আমার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, সেই সাথে কমতি ছিল প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতার, তাই এটা কোনো সহজ কাজ ছিল না আমার জন্য। আমি অঁকতাম, আবার ছিড়ে ফেলতাম, আবার আঁকতাম, নিরবচ্ছিন্নভাবেই অমি অঁকতাম। কিন্তু এখন অমি যখন সেই চিত্রকর্মগুলোর দিকে তাকাই,অমি দেখতে পাই তারা পরিপূর্ণ হয়ে অছে নির্ভেজাল দুঃখ কষ্টে। হতে পারে সেগুলো অংঙ্কন কৌশলের দিক থেকে অপরিপক্ক,কিন্তু সেগুলো ছিলো কঠোর প্রচেষ্টার ফসল। অমার অন্তর চেষ্টা করতো তাকে জাগিয়ে দিতে। যখন আমি স্কেচ গুলোর দিকে তাকাতাম, আমি কান্না না করে থাকতে পারতাম না। আমি অসংখ্য ছবি একেঁছি, কিন্তু কোনো কিছুই আমার চোখে পানি আনতে পারতো না।

আমার বোনের মৃত্যু একধরনের প্রভাব ফেলল আমার উপর। এটা পরিণত হলো ক্লাস্ট্রোফোবিয়া বা আবদ্ধতাভীতিতে। যেহেতু আমি দেখেছিলাম তাকে একটি আবদ্ধ ছোট কফিনে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে এবং খুব ভালোভাবে বন্ধ করে দাহ করার জন্য নিয়ে যেতে, তাই আমি কোনো আবদ্ধ জায়গায় যেতে পারতাম না। দীর্ঘ সময় আমি লিফট ব্যবহার করতাম না। আমি এ্যালিভেটরের সামনে দাড়িয়ে থাকতাম আর ভাবতাম এটা ভূমিকম্পে স্বংয়ক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে এবং আমাকে নিয়ে যাবে কোনো সংকীর্ণ আবদ্ধ জায়গায়। এ ধরনের চিন্তাই যথেষ্ঠ ছিল আমার মধ্যে প্রচন্ড অতংকের উদ্রেক করতে।

আমার বোনের মৃত্যুর ঠিক পরপরই এই উপসর্গ গুলো দেখা যায় দেয়নি। তিন বছর সময় লেগেছিল এগুলো সামনে আসতে। আর্ট স্কুল শুরু করার পর আমি একটি খন্ডকালীন চাকরি নিয়েছিলাম। একটি চালু কোম্পানিতে। তখনই প্রথমবারের মতো একটা অতংক গ্রাস করলো। একটি বক্স ট্রাকে আমি ছিলাম চালকের সহযোগী । বক্স বোঝাই করা, সেগুলো বের করে আনা ছিল কাজ। একদিন একটা সময় আমি ভুলক্রমে একটি শূন্য কার্গো কম্পার্টমেন্টে আটকে গেলাম। সেই দিনের মতো কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং চালক ভুলে গিয়েছিল চেক করতে যে কেউ ট্রাকের ভেতর অছে কি না। সে দরজা বন্ধ করে দেয় বাহির থেকে।

আড়াইঘন্টা অতিক্রম হওয়ার আগেই দরজা খোলে গিয়েছিল এবং আমি হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে সক্ষম হই। পুরো সময়টা আমি অবরুদ্ধ ছিলাম একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায়। এটা শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কোনো ট্রাক ছিল না,তাই কিছু ফাঁক ছিল যাতে সহজেই বাতাস ঢুকতে পারতো। যদি আমি ধীর স্থির ভাবে চিন্তা করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আর আমার শ্বাসরোধ হয়ে আসার মতো অবস্থা হতো না।

কিন্তু একটা ভয়ংকর আতংক আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সেখানে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন ছিল। তবুও আমি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারছিলাম না। শ্বাসক্রিয়া সংকীর্ণ হতে লাগলো এবং আমি অঝোরে কান্না শুরু করলাম। আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম। “সব ঠিক আছে শান্ত হও,আমি নিজেকে নিজে বললাম।” তুমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসতে সমর্থ হবে। এখানে দমবন্ধ হয়ে আসাটা অসম্ভব।” কিন্তু কোনো যুক্তিই যেন কাজ করছিল না। শুধু একটা জিনিস আমার মনের ভিতর ছিল আমার ছোট বোন, যাকে একটা ছোট কফিনে আবদ্ধ করে দাহ করার জন্য পাঠানো হয়। ভয়ংকর, আমি ট্রাকের দেয়ালে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলাম।

একটা ভয়ংকর আতংক আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সেখানে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন ছিল। তবুও আমি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারছিলাম না। শ্বাসক্রিয়া সংকীর্ণ হতে লাগলো এবং আমি অঝোরে কান্না শুরু করলাম।

ট্রাকটা ছিলো কোম্পানির পার্কিং লটে এবং সব কর্মচারীরা তাদের কাজ শেষে বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমার অনুপস্থিতি কারো নজরে পড়েনি। আমি পাগলের মতো ধাক্কা দিতে লাগলাম, কিন্তু মনে হচ্ছিল কেউ শুনছে না। আমি জানতাম, যদি আমি দুর্ভাগা হই তাহলে সকাল হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। এটা ভাবতে ভাবতেই আমি অনুভব করলাম, আমার সারা শরীরের মাংসপেশী যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

অবশেষে পার্কিং লটের নৈশপ্রহরী তার দায়িত্ব পালন করতে এসে আমার জোরে জোরে ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পান এবং আমাকে উদ্ধার করেন। যখন তিনি দেখলেন, আমি অনেক বিচলিত এবং অসুস্থ; তিনি আমাকে কোম্পানির বিছানার উপর শুইয়ে দিলেন এবং এক কাপ গরম চা খাওয়ালেন। আমি জানিনা সেখানে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম। তবে শেষপর্যন্ত আমার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। ভোর হয়ে আসলে আমি গার্ডকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রথম ট্রেনেই বাড়ি ফিরে আসি। বাসায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আর দীর্ঘ সময় ধরে পাগলের মতো কাঁপতে থাকলাম।

ঠিক তখন থেকেই লিফটে উঠা একটা আতংকের মতো ছিল। এই ঘটনাই একটা ভয় জাগিয়ে তোলে যা আমার ভেতরে সবসময়ই ছিল। আর এটা শুধু এ্যালিভেটরের ব্যাপরই ছিল না, যে কোনো আবদ্ধ জায়গার ক্ষেত্রে এমন মনে হত। এমনকি সিনেমার যে দৃশ্যগুলোতে কোনো সাবমেরিন অথবা ট্যাংক ছিল, তা দেখতে পারতাম না। শুধু নিজেকে সেই রকম আবদ্ধ জায়গায় ভাবতে থাকতাম আর নিঃশ্বাস নিতে পারতাম না। প্রায়ই আমাকে উঠে যেতে হতো এবং থিয়েটার ছেড়ে যেতে হতো। আর এ কারনেই আমি খুব কমই সিনেমা দেখতে যেতাম।

যখন আমার বয়স তেরো এবং আমার বোনের দশ, গ্রীষ্ম অবকাশের সময় আমরা দুজনে ভ্রমণে বের হয়েছিলাম। আমাদের মামা কাজ করতেন ইয়ামানাশির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এবং আমরা তার সাথেই সেখানে থেকেছিলাম। সেটা ছিলো আমাদের নিজেদের প্রথম ভ্রমণ। আমার বোন তখন কিছুটা ভালো অনুভব করছিল, তাই বাবা-মা আমাদের একাকী ভ্রমণ করার অনুমতি দেন।

আমাদের মামা ছিলেন অবিবাহিত (এবং এখনো অবিবাহিত) এবং তখন তার বয়স ছিল ত্রিশের মতো। তিনি জিনের উপর গবেষণা করতেন (এবং এখনো)। তিনি ছিলেন অনেক শান্ত এবং অবৈষয়িক, উন্মুক্ত, অকপট একজন ব্যক্তি। তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সবকিছুই জানতেন। তিনি অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে পাহাড়ে হাঁটা বেশি উপভোগ করতেন। আর এ কারণেই তিনি গ্রামীণ পাহাড়ী ইয়ামানাশির বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়েছিলেন, বলে জানিয়েছিলেন। আমার বোন এবং আমি মামাকে অনেক বেশি পছন্দ করতাম।

আমাদের পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে সিনজুকু স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনটি ছেড়ে গেল ম্যাটসুমুটুর উদ্দেশ্যে। আমরা কফুতে গিয়ে নামলাম। মামা কফু স্টেশনে আসলেন আমাদের নেয়ার জন্য। তিনি ছিলেন দর্শনীয়ভাবে লম্বা এবং আমরা স্টেশনের ভীড়ের মাঝেই তাকে চিহ্নিত করতে পারি। তিনি কফুতেই একটি ছোট বাসা ভাড়া করে থাকতেন তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে। কিন্তু তার রুমমেটরা তখন বিদেশে থাকায় আমাদেরকে একটা কক্ষ দেয়া হয় ঘুমানোর জন্য। আমরা এক সপ্তাহ সেই বাসাতেই ছিলাম। এবং প্রায় প্রতিদিন আমরা মামার সাথে কাছাকাছি পাহাড়গুলোতে হাঁটতে বের হতাম। তিনি আমাদের সব রকমের ফুল এবং পোকামাকড়ের নাম শেখালেন। গ্রীষ্মকালীন সেই সময়গুলো আমরা আমাদের স্মৃতিতে সযত্নে লালন করতাম।

একদিন আমরা খানিকটা দূরে মাউন্ট ফুজির কাছে বায়ু গুহা ভ্রমনে যাই। মাউন্ট ফুজির আশেপাশে অসংখ্য বায়ু গুহা আছে। তার মধ্যে একটা ছিল বিশাল বড়। আমাদের মামা বললেন, কিভাবে এই গুহাগুলো গঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কে। তিনি আরো বললেন, এগুলো গঠিত হয়েছে আগ্নেয়গিরিজাত শিলা দ্বারা, যার কারণে এর ভিতরে তোমরা কোনো প্রতিধ্বনি খুব কমই শুনতে পাবে। এমনকি গ্রীষ্মেও এখানে তাপমাত্রা কম থাকে। অতীতে লোকজন এই গুহার ভিতর বরফ জমা করতো আর শীতকালে সেগুলো কাটতো। তিনি দুই ধরনের গুহার মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করলেন একটি হলো ফুকেটসু যেটা সবচেয়ে বড় এবং লোকজন অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে এবং আরেকটি হলো কাযায়ানা, যেটি সবচেয়ে ছোট এবং যেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। মনে হলো, মামা সবকিছুই জানেন।

বড় বায়ু গুহার প্রবেশমুখে টাকা দিয়ে ঢুকতে হতো। মামা আমাদের সাথে গুহার ভিতর গেলেন না। কারণ তিনি অসংখ্যবার গিয়েছেন সেখানে; তাছাড়া তিনি এত লম্বা আর গুহার ছাদ এতো নিচু যে দিনশেষে তার মেরুদণ্ড ব্যাথা করতো। মামা বললেন, “এখানে কোনো বিপদ নেই”, তোমরা দুইজন সামনে এগিয়ে যাও, আমি প্রবেশদ্বারে দাড়িয়ে থাকব এবং বই পড়ব।” প্রবেশদ্বারে দায়িত্বরত ব্যক্তি আমাদের হাতে একটি করে ফ্লাশলাইট এবং হলুদ রঙের প্লাস্টিক হেলমেট দেন। গুহার ছাদে আলোকসজ্জা ছিল, তারপরেও ভিতরে বেশ মনোরম অন্ধকার ছিল। আমরা যতই গুহার ভিতর গেলাম, ছাদ ততই নিচু হতে থাকলো।

আমার ছোট বোন এবং আমি ফ্লাশলাইটের আলো জ্বালিয়ে গুহার ভিতর হাঁটতে থাকলাম। তখন ছিলো মিডসামার। বাহিরে তাপমাত্রা ছিল ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কিন্তু গুহার ভিতরটা ছিলো শীতল, তাপমাত্রা ছিলো ৫০ ডিগ্রির নিচে। আমাদের মামার আদেশ অনুযায়ী আমরা পাতলা উইন্ডব্রেকার পরিধান করেছিলাম। আমার বোন শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছিলো যাতে দু’জন একজন আরেকজনকে সুরক্ষা দিতে পারি এবং পৃথক না হয়ে পড়ি। পুরো সময়টা জুড়ে একটা উষ্ণ-ছোট হাত আমার হাতের ভিতর ছিল। অন্যান্য দর্শনার্থীরা ছিলো মধ্যবয়স্ক যুগল। কিন্তু তারা তাড়াতাড়ি চলে যায় এবং শেষপর্যন্ত শুধু আমরাই ছিলাম।

আমার ছোট বোনটার নাম ছিল কোমিচি। তবে পরিবারের সবাই তাকে ডাকতো কমি বলে। তার বন্ধুরা তাকে ডাকতো মিশি বা মিশান বলে। যতদূর আমি জানি, তার পুরো নাম ধরে তাকে কেউ সম্বোধন করতো না। সে ছিলো ছোটখাটো পাতলা গড়নের। তার ছিল সোজা কালো চুল, যা তার কাঁধ পর্যন্ত সুন্দর করে ছাঁটা ছিল। তার ডাগর চোখ ছিল আর ভিতরের মনিগুলোও ছিল বড়। যেন দেখতে ঠিক পরীর মতো। সেই দিন তার পরনে ছিল সাদা টি-শার্ট, ধূসর রঙের জিনস এবং গোলাপি কালারের স্নিকার্স জুতো।

গুহার গভীরে ঢুকে যাওয়ার পর আমার বোন সামান্য দূরে একটা ছোট গুহা আবিষ্কার করে। এটার মুখ পাথরের ছায়ার আড়ালে ছিল। ছোট গুহার প্রতি তার আগ্রহ হলো। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার মনে হয় না যে এটা দেখতে এলিসের রেবিট হোলের মতো?

লিউইস ক্যরোলের “এলিস’স এডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড “র অনেক বড় ভক্ত ছিল আমার ছোট বোন। আমি ঠিক জানিনা কতবার তাকে আমার পড়ে শোনাতে হয়েছে এটা। অবশ্যই একশতবারেরও বেশি হবে। সে পড়তে পারতো তারপরেও আমাকে জোরে জোরে পড়ে শুনাতে হতো। সে সেটা অনেক পছন্দ করতো। সে সেইসব গল্পগুলো মুখস্থ করে ফেলতো। এবং যখন আমি পড়তাম সে উত্তেজিত হয়ে উঠতো। তার পছন্দের অংশ ছিলো লবস্টার কাডরিলে। এখন পর্যন্ত আমি সেই অংশের প্রত্যেকটা শব্দ মনে করতে পারি।

আমি তাকে বললাম এখানে কোনো ইঁদুর নেই। সে বলল, আমি ভিতরে উঁকি দিচ্ছি। আমি বললাম,”খুব সাবধান”।
এটা সত্যিই একটা সংকীর্ণ গর্ত (মামার সংজ্ঞা অনুযায়ী কাযা-আনার কাছাকাছি), কিন্তু আমার ছোট বোন কোন সমস্যা ছাড়াই ঢুকে যেতে সমর্থ হয়েছিল। সে সম্ভবত ফ্লাশলাইটের আলো দিয়ে হোলের ভিতরটা দেখছিল। সে জানালো “ভিতরটা অনেক গভীর। মেঝেটা নিচের দিকে খাড়া ঢালু প্রকৃতির। ঠিক দেখতে এলিসের রেবিট হোলের মতো। আমি ভিতরে শেষ পর্যন্ত দেখতে যাচ্ছি।”
“না এটা ঠিক না। এটা অনেক বিপজ্জনক।” আমি বললাম।
“ঠিক আছে। আমি ছোট এবং আমি সহজেই বের হয়ে আসতে পারব।” সে বলল।

সে তার উইন্ডব্রেকারটা রেখে গেলো। আর তার পড়নে ছিলো শুধুমাত্র টি -শার্ট। সে আমার হাতে জ্যাকেটের সাথে হেলমেটও দিয়ে গেল। তাকে বাধা দেয়ার আগেই গুহার ভিতর পেঁচিয়ে ঢুকে গেল। হাতে ছিল ফ্লাশলাইট। মুহূর্তের মধ্যেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়, কিন্তু সে আর বের হয় না। আমি একটা শব্দও শুনতে পেলাম না।
আমি হোলের সামনে গিয়ে ডাকলাম “কমি, কমি! তুমি কি ঠিক আছো?”

কোনো উত্তর পেলাম না। না কোনো প্রতিধ্বনি, অন্ধকারের ভিতর আমার গলার স্বর যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিলো। সে মনে হয় গর্তের ভিতর আটকে গিয়েছিলো, সামনে বা পেছনে চলাচল করতে পারছিল না অথবা তার খিঁচুনির সমস্যা হয়েছিল এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। যদি তাই ঘটতো আমি তাকে সাহায্য করতে পারতাম না। সমস্ত প্রকারের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো আমার মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকলো। চারিদিকের অন্ধকারে যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিলো।

যদি সত্যিই আমার ছোট বোন হোলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেত, আর কখনোই ফিরে না আসতো, তাহলে আমি বাবা-মায়ের কাছে কি ব্যাখ্যা দিতাম? আমার কি দৌড়ে গিয়ে বাহিরে প্রবেশদ্বারে অপেক্ষারত মামাকে বলা উচিত এ বিষয়ে? অথবা আমার উচিত শক্ত হয়ে বসে থাকা এবং তার বের হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করা? আমি গর্তের ভিতর ফ্লাশলাইট দ্বারা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফ্লাশলাইটের আলো অত গভীরে গিয়ে পৌঁছাল না। এটা ছিল ছোট একটা গর্ত, এবং অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

“কমি”, আমি আবার ডাকলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। “কমি”,আমি আরও জোরে ডাকলাম। কোনো উত্তর নেই। একটা শীতল বাতাসের প্রবাহ আমার শিরদাড়া পর্যন্ত ছুয়ে গেল। আমি বোধ হয় তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। খুব সম্ভবত সে আটকে আছে এলিসের হোলে, মক টার্টেল, চেশায়ার ক্যাট, কুইন অব হার্টের ওয়ার্ল্ডে। এখানে কোনো যুক্তি যেন কাজ করছিল না। আমাদের এখানে আসা উচিত হয় নি, আমি ভাবলাম।

কিন্তু শেষপর্যন্ত আমার ছোট বোন ফিরে আসলো। গর্ত থেকে প্রথমে তার কালো চুল বের হলো, তারপর তার কাঁধ এবং হাত, সবশেষে তার গোলাপি রঙের স্নিকার্স। সে নিঃশব্দে আমার সামনে এসে দাড়ালো। সে ধীরে আর গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল এবং তার জিন্স থেকে ময়লা ঝাঁড়লো।

তাকে দেখা মাত্রই আমার হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করলো। আমি কাছে গিয়ে তার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়েছিলাম। ফ্লাশলাইটের ক্ষীণ আলো দিয়ে গর্তের ভিতর কিছুই দেখতে পারছিলাম না, তবে মনে হয় প্রচুর ধুলাবালি এবং ময়লা ছিল যা তার সাদা টি-শার্টে লেগে আছে। আমি তার হাতে উইন্ডব্রেকার এবং হলুদ হেলমেট দিলাম।
“আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি ভাবতে পারছিলাম না তুমি আবার ফিরে আসবে।”
“তুমি চিন্তা করছিলে?”
“অনেক বেশি”।
সে শক্ত করে আমার হাত ধরল। এবং উত্তেজিত কণ্ঠে সে বলল, “আমি সংকীর্ণ জায়গা, গভীর এবং নিচু সব জায়গায় ঘুরে দেখেছি। এটা একটা ছোট ঘরের মতো। একটা বৃত্তাকার কক্ষ, ঠিক যেন বলের মতো। এর ছাদটাও বৃত্তাকার, দেয়াল এবং মেঝেও বৃত্তাকার। আর এত নিস্তব্ধতা সারা পৃথিবী খুঁজেও পাওয়া যাবে না। মনে হয়েছিল আমি সমুদ্রের একেবারে তলদেশে চলে গিয়েছিলাম। আর এটা ছিল আলকাতরার মতো কালো অন্ধকার। কিন্তু আমার কোনো ভয় বা একাকী অনুভব হচ্ছিল না। সেই কক্ষটাই একটা বিশেষ জায়গা আমার জন্য যেখানে কেবল আমি প্রবেশ করতে পারি। এই কক্ষটা শুধু আমার জন্য। কেউ সেখানে ঢুকতেই পারে না। তুমিও পারবে না।”
“কারণ আমি অনেক বড়।”
আমার ছোট বোন মাথা দুলিয়ে বলল- একদম ঠিক। তুমি এত বড় যে কখনোই তুমি ঢুকতে পারবে না। এবং আশ্চর্যের বিষয় এটা অন্য যে কোনো জায়গা থেকে অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর এত অন্ধকার যে যদি ফ্লাশলাইটের আলো নিভিয়ে দাও তাহলে তোমার হাত দিয়েই অন্ধকার আঁকড়ে ধরতে পারবে। ধীরে ধীরে তোমার দেহ অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকবে। এটা যেহেতু অনেক অন্ধকার তুমি দেখতে পারবে না কি ঘটছে। তুমি বুঝতে পারবে না তোমার দেহের অস্তিত্ব আছে কি নেই। এমনকি আমার দেহও সেখানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত সুন্দর, নাহ? কিন্তু যখন আমি সেখানে ছিলাম আমার কোনো অদ্ভুতুড়ে বা ভুতুড়ে কিছুই মনে হচ্ছিল না। আমি সারাজীবন সেখানেই থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভাবলাম তুমি অনেক দুঃশ্চিন্তা করবে, তাই বের হয়ে আসলাম।”
“চলো বের হই”, আমি বললাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে সারাক্ষণ কথাই বলতে থাকবে। এক পর্যায়ে আমি তাকে থামিয়ে বলি “আমি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।”
‘তুমি ঠিক আছো তো?’ আমার বোন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।
“আমি ঠিক আছি তবে এখনই বের হতে চাচ্ছি।”
আমরা হাত ধরাধরি করে বের হওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করলাম।
হাঁটার সময় আমার বোন নিচু কণ্ঠে বলল,” তুমি কি জানো? এলিসের সত্যিই অস্তিত্ব আছে। এটা কোনো বানানো গল্প নয়। এটা সত্যি ছিল। মার্চ হেয়ার, মেড হ্যাটার, চেশায়ার ক্যাট, প্লেইং কার্ড সোলজার্স -তাদের সবারই অস্তিত্ব আছে।
“হতে পারে।” আমি বললাম।
বায়ু গুহা থেকে বের হয়ে আমরা বাস্তবের আলোকিত পৃথিবীতে ফিরে আসি। সেইদিন পড়ন্ত বিকালে আকাশে মেঘের পাতলা আবরণ ছিল। কিন্তু আমি এখনো মনে করতে পারি সেইদিন সূর্যের কি প্রখর তাপ ছিল। আমার মামা গুহার প্রবেশমুখে একটি বেঞ্চের উপর বসে বইয়ের ভিতর মগ্ন হয়ে ছিলেন। আমাদের দেখামাত্রই তিনি স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

দুই বছর পর, আমার বোন মারা গেল। এবং তাকে ছোট কফিনে করে নিয়ে যাওয়া হলো দাহ করার জন্য। আমার বয়স তখন পনেরো আর তার বারো। তাকে দাহ করার সময় আমি আমার পরিবারকে রেখে কোর্ট ইয়ার্ডের বেঞ্চের উপর বসেছিলাম। এবং স্মরণ করছিলাম কি ঘটেছিল সেই বায়ু গুহাতে; যেখানে আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন আমার বোন বের হয়ে আসবে। অন্ধকারের হালকা আভরণ আমাকে গ্রাস করছিল, একটা গভীর শীতলতা অনুভব করেছিলাম। তার কালো চুল বের হয়ে আসে গর্ত থেকে, তারপর তার কাধ। অনেক ময়লা এবং ধুলোবালি লেগেছিল তার সাদা জামায়।

ঠিক সেই সময়, একটা চিন্তা আমার মাথায় আসলো। এটাও তো হতে পারে যে, চিকিৎসক তার মৃত্যু ঘোষণা করার দুই বছর আগেই তার জীবন তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল যখন সে গুহার একেবারে গভীরে ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমার তাই ধারণা ছিল। সে তখনই গর্তে হারিয়ে গিয়েছিল চিরতরে। কিন্তু আমি ভুলক্রমে ভেবেছিলাম সে জীবিত ছিল। তাকে আমি আমার সাথে করে ট্রেনে ফিরে আসলাম টোকিও। তার হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম। এবং আরো দুই বছর আমরা ভাই-বোন হিসেবে জীবনযাপন করলাম। কিন্তু ক্ষণকালীন সময় ছাড়া সেসব আসলে কিছুই ছিল না। দুই বছর পর, গুহা থেকে মৃত্যু হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এসে আমার বোনের আত্মা গ্রাস করে নিয়ে গেল। ঠিক যেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছিল, আমাদের এখন ধার পরিশোধ করতে হবে। মালিক এসেছে তার জিনিস ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য।

অনেক বছর পর, একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমি উপলব্ধি করলাম যে, সেই বায়ু গুহায় আমার ছোট বোন নিচু স্বরে যা বলেছিল তা আসলে সত্যিই ছিল। এই পৃথিবীতে এলিসের অস্তিত্ব আছে। মার্চ হেয়ার, ম্যাড হেটার, চেশায়ার ক্যাট- তাদের সবারই অস্তিত্ব আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here