বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে ‘১৮ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগপর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের অনুমতি না দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে’ এবং বলেছে, ‘এ সময়ে শুধু ভোটের প্রচার চালানো যাবে।’ নির্বাচন কমিশনের পাঠানো এ চিঠি একাদিক্রমে দেশের সংবিধান পরিপন্থী, তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত ও কৌতুককর।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ প্রশ্ন তুলেছেন,
“নির্বাচন কি একটি অরাজনৈতিক বিষয়”
তিনি লিখেছেন,
‘অতীতে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন কার্যক্রমে নির্বাচনকে একটি ছেলেখেলায় পরিণত করার মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে অনেক দল আছে, যাদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম সুবিদিত, তাদের বাদ দিয়ে তিনটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া। এদের ‘কিংস পার্টি’ বলেই সাধারণভাবে অভিহিত করা হচ্ছে। এগুলো তৈরির পেছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করেছে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন অবগত ছিল না, তা মনে করার কারণ নেই।
এ ছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষক অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে যে আচরণ করা হয়েছে, তা-ও স্মরণ করা যেতে পারে। নামসর্বস্ব ও প্রায় অস্তিত্বহীন সংগঠনগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অতীতের বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে সমালোচনার মুখে প্রথম দফায় বাদ দেওয়া হলেও পরের দফায় তাঁদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করা বিষয়ে সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্যও কৌতূহলোদ্দীপক।
নির্বাচন কমিশনের অনুরোধকে কেন সংবিধান পরিপন্থী মনে হচ্ছে, সেটা বুঝতে সংবিধানের দিকে তাকানো দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ যদিও এ ধারায় অন্তর্ভুক্ত ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে সীমিত করে এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়, তদুপরি এ অনুচ্ছেদ কোনো অবস্থাতেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সারা দেশে সমাবেশ করতে না দেওয়ার বা তা স্থগিত করার কোনো বিধান দেয় না।
আইন বড়জোর স্বল্প সময়ের জন্য স্থানীয়ভাবে সমাবেশ বন্ধ করতে পারে। সারা দেশে সমাবেশ বন্ধ করা সম্ভব, যদি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত ধারাগুলো স্থগিত করা হয়। জরুরি অবস্থাবিষয়ক অনুচ্ছেদ ১৪১-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত আছে। ১৪১খ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন অনুচ্ছেদগুলো স্থগিত করা যাবে। তার মধ্যে ৩৭ অনুচ্ছেদও আছে।
জরুরি অবস্থা জারির এ বিধানের সঙ্গে আমার ভিন্নমত আছে। কিন্তু সেখানে ৩৭ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করার একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ বিধানের বাইরে নির্বাহী বিভাগ ৩৭ অনুচ্ছেদ স্থগিত করতে পারে না। বাংলাদেশে যেহেতু জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি, ফলে সাধারণভাবে বলা যায়, আইনিভাবে সারা দেশের জন্য এ অধিকার স্থগিত করা কিংবা তার জন্য সুপারিশ করা সংবিধান পরিপন্থী।
নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বিষয়ে সংবিধানের বিধানগুলো লিপিবদ্ধ আছে ১১৮ অনুচ্ছেদে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ কিন্তু এটা কোথাও বলা হয়নি, নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগকে এমন অনুরোধ করতে পারে, যা সংবিধানের আওতার বাইরে।
নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের বাইরে যা আছে, তা হচ্ছে আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আইন। বর্তমানে বহাল এ আইনের ভাষ্য, অর্থাৎ গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আইন, ২০২৩ নির্বাচন কমিশনকে এ ধরনের অধিকার দেয় কি যে কমিশনাররা বলবেন কে কী ধরনের রাজনীতি করবে, কী কথা বলবে?
নির্বাচন কমিশনের এ চিঠিতে বলা হচ্ছে, ‘নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে, ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন, এমন কোনো সভা, সমাবেশ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে সকলকে বিরত রাখা বাঞ্ছনীয়।’(প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩) নির্বাচনী কাজে বাধা বলতে কমিশন কী বোঝায়, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়নি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটি নির্বাচনের সময় যদি নির্বাচনে উৎসাহিত করা যায়, তবে নিরুৎসাহিত করা যাবে না কেন? যেকোনো দল, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কি এটা মনে করতে পারেন না—এ নির্বাচন বিরাজমান অবস্থার বদল ঘটাবে না? তিনি কি তা বলতে পারবেন না? সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় (স্বল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে) ভোট দেওয়া ও না দেওয়া নাগরিকের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে তাঁদের সমাবেশ করা এবং ব্যক্তিগতভাবে কিংবা গণমাধ্যমে তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করার সুযোগ কারোরই নেই।
নির্বাচন কমিশনের চিঠিতে বলা হচ্ছে ‘কর্মসূচির’ অনুমোদন না দিতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের বক্তব্য গণমাধ্যমে দেওয়াও কি নিয়ন্ত্রিত হবে, নির্বাচন কমিশন কি গণমাধ্যমে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বলাকেও প্রকারান্তরে নিয়ন্ত্রণের জন্য বলছে? বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার মাত্রা বিষয়ে সবাই অবগত, কথা বলার অধিকার কতটা আছে, তা-ও সবার জানা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সিভিকাস বলেছে, ‘বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের কথা বলার স্থান বন্ধ হয়ে গেছে।’ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের ছয়টি সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। তারা বলেছে, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিক পরিসর সংকুচিত হয়েছে। এ কাজে ক্ষমতাসীন দল, সরকারের নির্বাহী বিভাগই কেবল যুক্ত নয়, এখন নির্বাচন কমিশনও তাতে যুক্ত হয়েছে বলেই দেখা যাচ্ছে’- বলে আলী রিয়াজ মনে করেন।
জনগনের ভোটের অধিকার রক্ষার চলমান আন্দোলনকে দমন করার জন্য সংবিধান বিরোধী এই পদক্ষেপ নেয়া হলে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
এই অবস্থার দায় কোনভাবেই নির্বাচন কমিশনার এড়িয়ে যেতে পারবে না। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসেবে ইসির এই ভূমিকা ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।
কাজেই ইসি এই অবস্থান থেকে সরে এসে জনগনের ভোটের অধিকার রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিলে হারানো সম্মান ফিরে পাবেন এবং জনগনের কাছে তাদের নায়কোচিত ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জনগন আশা করি ইসির শুভ-বোধের উদয় হবে। এইসব ন্যাক্কারজনক ভূমিকা থেকে সরে আসতে হবে।