ভোটবিহীন ভাগাভাগির নির্বাচনে জাপা ও ১৪ দলীয় শরিকদের সামনে যে ক্ষতি ও সুযোগ অপেক্ষা করছে
বিশেষ প্রতিবেদন:
নির্বাচনের আগেই এই নির্বাচনের ফলাফল সকলেরই জানা এবং গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে- এটাই ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারীর নির্বাচনের সাথে বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনের মৌলিক পার্থক্য মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
দফায় দফায় শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু আসন ভাগাভাগি বা সমঝোতার বিষয়ে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪-দলীয় জোটকে চূড়ান্ত কথা দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনেরা, যা ২০১৪ এবং ২০১৮ তে ঘটেনি। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত এভাবে শরিক ও মিত্রদের অপেক্ষায় রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জাপা ও ১৪ দলের শরিকেরা, যারা নাকি আবার তথাকথিত বিরোধীদল, আসন নিশ্চয়তার আশায় ঘুরছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পেছনে পেছনে।
বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলো ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনকে সামনে রেখে একের পর এক পরীক্ষায় ফেলছেন তামাশার নির্বাচনের প্রধান আয়োজক আওয়ামী লীগ ও শরিকদলগুলো। সবচেয়ে বড় যে পরীক্ষার মধ্যে এরা পড়তে যাচ্ছে তা হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে এরা চিরতরে দেউলিয়া হয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক জনগণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে তাদের জন্য রাজনীতির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে যদি তারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের এই সাজানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এই ধরণের প্রতারণার ফলে দলগুলো রাজনীতিশুণ্য হয়ে পড়বে- যেই ক্ষতি অদূর ভবিষ্যতে এই দলগুলো পুষিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। আর এটাই শরিকদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতির দিক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আর সুযোগ বলতে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার হিসেব। কিন্তু তাতেও শরিকরা প্রতিনিয়ত অপমানিত ও প্রতারিত হচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার ভাগ পাবেন এমন কোন নিশ্চয়তা পাওয়ার বদলে তারা দেখছেন আওয়ামী লীগ তাদের ব্যবহার করে নির্বাচনের এই পাতানো খেলাকে জমিয়ে তুলতে চাইছে। লাভের অংশে তাদের ভাগ্যে আসন পাওয়া বা ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার চেয়ে ক্ষতির দিকটিই বেশি হচ্ছে, সাদা চোখে অন্ততঃ দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও এর শরিক–মিত্রদের সূত্রে জানা গেছে, ভাগে পাওয়া আসনে জয়ের নিশ্চয়তা পেতে জাপা ও শরিকেরা আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র সব প্রার্থীর প্রত্যাহার চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসন ধরে ধরে আলোচনার আগ্রহী নয়। জোট ও মিত্র দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জয়ী হতে সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে—এটুকু আশ্বাস দিচ্ছে। এ ছাড়া ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে বলছে।
৪ ডিসেম্বর ১৪ দলের শরিকেরা শেষ ভরসা শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এতে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেননি তিনি। জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে শরিকেরা একাধিকবার আমির হোসেন আমুর সঙ্গে বৈঠক-সাক্ষাৎ করেছেন। চার-পাঁচটি শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী থাকবে না—এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। কেবল মূলা ঝুলানো রয়েছে।
একই অবস্থা সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাপারও। জাপার নেতাদের একটি দল গত সপ্তাহে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নির্বাচন হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন, কিন্তু জাপাকে আসন ছাড়ের বিষয়ে নিশ্চয়তা দেননি। তিনি বরং এ বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দেন। এরপর গত বুধবার রাতে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতার জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে গুলশানের একটি বাসায় বৈঠক হয়। গত শনিবার রাতেও আবার বৈঠক হয় দুই পক্ষের। তবে এতে ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন না। জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বৈঠকগুলো করা হচ্ছে অত্যন্ত গোপনীয়তায়। বৈঠকের স্থান ও সময় কাউকে জানানো হচ্ছে না। বৈঠকে কারা অংশ নিচ্ছেন এবং কী আলোচনা হচ্ছে, তা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্যই এই গোপনীয়তা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, জাপার সঙ্গে সমঝোতাসংক্রান্ত আলোচনা বহুমুখী। আওয়ামী লীগ শুধু নির্বাচনের পরিবেশ, নির্বাচনে জাপা থাকলে কী সুবিধা পাবে, বিএনপির ভোট কীভাবে টানা যায়—এসব বিষয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। অন্যদিকে জাপা চায় আসনের নিশ্চয়তা। নতুবা দলের সব নেতাকে ভোটে রাখা যাবে না—এমনটাও তারা বলছে। তবে জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের হয়ে বিভিন্ন এজেন্সিও কথা বলছে বলে শোনা যায়। এসব আলোচনায় জাপাকে কিছু আসনে জিতিয়ে আনার আশ্বাস দেওয়া হলেও এটাকেও মরীচিকা বলছেন অনেকে। সরকার জাপাকে বোকা বানিয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চায়।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কৌশল চূড়ান্ত করার বিষয়টি অনেকটাই আটকে আছে জাপায়। কারণ, জাপার সঙ্গে আসন–সমঝোতা করে নির্বাচন হলে একধরনের কৌশল নিতে হবে। আর জাপা একা নির্বাচন করলে আরেক কৌশল।
আওয়ামী লীগ ও জাপা সূত্র বলছে, জাপা অন্তত ৩৫-৪০ আসনে নিশ্চয়তা চাইছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জাপাকে আলাদা নির্বাচন করে বিএনপির ভোট টানতে পরামর্শ দিচ্ছে। এ ছাড়া জাপার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জিতিয়ে আনার বিষয়টি আওয়ামী লীগ দেখবে এমন ফাও বানী শোনাচ্ছে।
জাপা ও ১৪ দলের শরিকেরা দ্রুত সমঝোতা চায়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, যত সময় যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ততোই শক্তি অর্জন করছেন। শেষ মুহূর্তে সমঝোতা হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরিয়ে দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না তারা। আসলে এটাই আওয়ামী লীগের কুটকৌশল। তারা শেষ পর্যন্ত জাপা- ১৪ দল শরিকদের বোকা বানিয়ে ফায়দা লুটবে বলে অনেকেই মনে করছেন।
যদিও ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী মিডিয়াকে বলেন, জোটের শীর্ষ নেতাদের আসন–সমঝোতা একপ্রকার হয়ে গেছে। অন্যান্য আসনে সমঝোতা হতে আরও দু-এক দিন লাগতে পারে।
কিন্তু ১৪ দলের অন্য একাধিক শরিক দলের সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসন–সমঝোতায় অনীহা, সময়ক্ষেপণে শরিক দলগুলোর ভেতর অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এখন আর জাতীয় পার্টিকেও বিশ্বাস করেনা প্রধানমন্ত্রী। সে জন্যই তাদের জন্য কোন আসন ছেড়ে না দিয়ে বরঞ্চ আওয়ামী লীগের প্রার্থী/ড্যামি/স্বতন্ত্র/বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এদিকে জাপার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিদের বলেন, আলোচনা হচ্ছে গুটিকয় নেতার সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, আলোচনা ইতিবাচক। জাপা ভাগে আসন পেয়েছে কি না, সেটা কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না। এ অবস্থায় অনিশ্চয়তায় কত দিন অপেক্ষা করা যায়? ওই নেতা আরও বলেন, জাপার পক্ষে নির্বাচন বর্জন করা কঠিন। আবার অংশ নিয়ে একা জেতা সহজ নয়। ফলে তাঁরা একটা কঠিন সমস্যায় পড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি নির্বাচনের পক্ষে তাঁদের মত প্রকাশ করে যাচ্ছেন। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ না করলে এই নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হবেনা তা বোঝার জন্য রকেট সাইন্সের প্রয়োজন পড়েনা।
এদিকে সাম্প্রতিক এক টকশোতে এসে জাকের পার্টির একজন শীর্ষ নেতা ইংগিত দিলেন তারাও একযোগে মনোনয়ন প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন। কেননা ভোটের কোন পরিবেশ নেই, নেই কোন সমতল ভূমি।
আর এই সব জটিল সমীকরণেই উঠে আসছে লাভ ক্ষতির হিসেব। আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করলে পরিণতি কেমন হয় তা গত দুটি নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখানোর নামে শরিকদের বলি দেয়ার এই আয়োজন গোটা দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। এই জটিল পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক তাত্বিক ও পন্ডিতদের অভিমত হলো- সম্মিলিত ভাবে লেজ কাটার দলে যোগ দান না করে শরিকদলগুলো নির্বাচন থেকে সরে আসলে গোটা দেশের রাজনীতি ও তাদের নিজেদের নৈতিক ও রাজনৈতিক মৃত্যুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার পথ সহজ হয়ে যাবে। লীগের পক্ষে থেকে সম্মিলিত ভাবে রাজনৈতিক আত্মহননের চেয়ে ক্ষমতার সহজ লোভ ত্যাগ করে রাজনৈতিকভাবে জনগনের পাশে থাকলে, জন-আকাঙ্খার সাথে থাকলে তাদের সম্মান ও ভবিষ্যতে শক্তি ও শক্ত অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবে। ফলে ১৭ তারিখের আগেই তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এই নির্বাচনের বাইরে থাকার ঘোষণা দিতে পারলেই তা হবে বিচক্ষণ ও স্মার্ট সিদ্ধান্ত। এ মুহূর্তে ডুবন্ত নৌকায় না উঠে জনতার জোয়ারের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে নির্বাচন বর্জনই এখন সময়ের দাবী।
না হলে শরিকরা সব দিক থেকেই ক্ষতির মুখে পরবে। লীগের হাতে পরে তাদের রাজনীতির মৃত্যু যেমন হবে ভোটের মাঠেও আওয়ামী লীগের মনোনীত বা বিদ্রোহীর হাতে মার খাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আর আছে দলের ভেতরও অল্প হলেও সুভবোধ সম্পন্ন মানুষদের হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি।
বুঝতে হবে, জোর করে একতরফা নির্বাচনী তামাশা শেষ করতে পারলেও বাঁধভাঙ্গা জনরোষ, রাজনৈতিক উত্তাপ, আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বেহাল দশা ও আন্তর্জাতিক চাপে এ সরকার টিকতে পারবে না, তাতে আমও যাবে, ছালাও যাবে। তাই এখনই সময়, ডুবন্ত স্বৈরাচারের বদলে মজলুম জনতার কাতারে চলে আসার।
সব মিলিয়ে প্রহসনের এই পাতানো নির্বাচনে যোগদানের চেয়ে যেকোন বিবেচনায় বর্জনের মধ্য দিয়েই অর্জন হবে বেশি- এটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।