৩৯তম সার্ক চার্টার দিবস উপলক্ষে গত ৮ই ডিসেম্বর পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার সার্কের সদস্য দেশগুলো এবং দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, আট সদস্য দেশের এই সংগঠনের মধ্যে যেসব ইস্যুতে পুনরুজ্জীবনের বাধা আছে তা সমাধান করা হবে। অভিনন্দন বার্তায় প্রধানমন্ত্রী কাকার বলেছেন, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আস্থাশীল যে- বর্তমানে এই সংগঠনে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে মসৃণভাবে সংগঠনটিকে কার্যকর করতে তা সরিয়ে ফেলা হবে। এর মধ্য দিয়ে সার্কের সদস্য দেশগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতায় পারস্পরিক সুযোগ-সুবিধার দিকে ধাবিত হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী কাকারের এই বার্তা এমন এক সময়ে এলো যখন বাধ্যতামূলক সম্মেলন শুরুর জন্য বার বার পাকিস্তানের তরফ থেকে অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও বহুল আলোচিত এই সংগঠনটি দৃশ্যত তার উজ্বলতা হারিয়েছে। সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সার্ক সামিট অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে নেপালে। পরের সামিট হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে পাকিস্তানে। কিন্তু সম্মেলন থেকে ভারত নিজেকে প্রত্যাহার করার ফলে তা আটকে যায়। এতে বাংলাদেশ, ভুটান এবং আফগানিস্তান সমর্থন করে। ভারতের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলার পর এ ঘটনা ঘটে। নয়া দিল্লি ওই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের দায়ী করে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে আবারও সামিট আয়োজনের প্রস্তাব তোলে পাকিস্তান। এ সময় যদি শারীরিকভাবে উপস্থিত হতে অনীহা থাকে, তাহলে ভার্চ্যুয়াল ব্যবস্থায় অংশ নিতে ভারতের প্রতি প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পূর্বের অভিযোগ পুনরুল্লেখ করে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ভারত।
উচ্চ লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক। এসব লক্ষ্যের মধ্যে আছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, সমষ্টিগত আত্মনির্ভরশীলতা এবং একে অন্যের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থায় অবদান রাখা। এখন পর্যন্ত কখনোই শেষ হবে না- এমন বিরোধপূর্ণ ব্লকগুলোর কারণে সার্কে বিরোধ আছে। বড় দুটি সদস্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ আছে এক্ষেত্রে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম সমন্বিত অঞ্চলের মধ্যে আছে দক্ষিণ এশিয়া। এখানে মোট বাণিজ্যের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের পরিমাণ শতকরা মাত্র ৫ ভাগ। এখন সার্ককে নতুন করে সক্রিয় করার অসীম গুরুত্ব আছে। কারণ, আগে কখনো দেখা যায়নি এমন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দক্ষিণ এশিয়া। বিশ্বের মধ্যে প্রথম, পঞ্চম এবং অষ্টম সবচেয়ে জনবহুল দেশ যথাক্রমে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। এখানে বাজার ব্যবস্থাপনা নির্ভর করছে তরুণ জনসংখ্যার ওপর। এ অঞ্চলে মোট জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেকেরই বয়স ২৪ বছরের নিচে। এই তরুণ সমাজ প্রযুক্তি ব্যবহারে অধিকতর পারদর্শী, এর সুবিধা ভোগ করতে অধিক উন্মুক্ত। প্রযুক্তির একটি জায়ান্ট হয়ে উঠার জন্য বিপুল সুযোগ আছে ভারতের। কারণ, বিশ্বের শীর্ষ আইটি প্রতিষ্ঠাগুলো সরে আসছে ভারতে। ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এর জন্য উদ্ভাবনীর একটি প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়া। এমনটা বিবেচনা করছে বিশ্বব্যাংক। কিভাবে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থাকে একপাশে সরিয়ে রেখে তার স্থানে এমন সব প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেয়া হবে- যারা এসব প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্ভাবনীকে সামনে আনবে; এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা বড় অংশে কাজে দেবে। বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হলে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রখর হয়েছে ঝড়বৃষ্টি, খরা এবং বাড়ছে তাপমাত্রা। এসব এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর অন্যতম হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়া। আবাদযোগ্য জমির অভাব, ভয়াবহ পানির সঙ্কট, তীব্র তাপ এবং বার বার মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম। এই অঞ্চল এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, এর পরিণতি অপরিবর্তনীয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, গত দুই দশকে কমপক্ষে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার ৭৫ কোটি মানুষ। এ সময়ে গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতির পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ায় দাঁড়াতে পারে ৫১৮০০ কোটি ডলার। বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় নিয়ে এখনই সার্কের জন্য একসঙ্গে বসার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সমাধান নিয়ে গুরুতরভাবে চিন্তা করার উত্তম সময়। এই ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের ওপর জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বাতাসের গুণগত মানের ক্রমাবনতি আরেকটি ক্ষেত্র। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব সহযোগিতা অপরিহার্য। নজিরবিহিন ও বার্ষিক ভিত্তিকে বায়ু দূষণ দক্ষিণ এশিয়ায় কোটি কোটি মানুষের জীবনকে বিঘ্নিত করছে। এর ফলে স্কুল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে। প্রভাবিত হচ্ছে স্পোর্টস সংশ্লিষ্ট ইভেন্ট। সরকারগুলো জনগণকে ঘরের ভিতর থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই) অনুযায়ী, মারাত্মক বায়ু দূষণে দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের গড় আয়ু ৫ বছর কমে যাচ্ছে। যদিও সার্কভুক্ত দেশগুলো বাতাসের গুণগত মান মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপন করে, পরিকল্পনা ব্যবস্থা করে এবং জনগণকে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের দিকে আগ্রহী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সমস্যা সমাধানে, তাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমছে। কিন্তু এক এক দেশের আলাদাভাবে গৃহীত এ উদ্যোগ তেমন কোন ফল আনছে না।
এই অঞ্চল অভিন্ন কতগুলো হুমকি মোকাবিলা করছে। এগুলো প্রচলিত ও অপ্রচলিত হুমকি। পাকিস্তান ও ভারতের পক্ষে প্রচলিত ইস্যুগুলো বাদ দেয়া হয়তো কঠিন হবে। যেমন কাশ্মীর এবং সন্ত্রাস। কিন্তু এ অঞ্চলে অপ্রচলিত হুমকির যে ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে তা উভয় পক্ষকে কাছাকাছি আনতে পারে, তাতে সার্ক পুনরায় সক্রিয় হবে। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে সার্ক সামিট বন্ধ হয়ে থাকায় ভারতের অংশগ্রহণ এক্ষেত্রে হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ। যদি সার্কভুক্ত দেশগুলো অন্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মতো সাংগঠনিক কাজে সহায়তা করতে পারে, তাহলে তা একক কোনো দেশের জন্য ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি হবে না। তাতে পুরো অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হবেন।
( লেখাটি পাকিস্তানের অনলাইন দ্য নেশনে প্রকাশিত ‘সার্ক ইজ ডেড’ এর অনুবাদ) ড. আমিনা তানভীর