রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট রাষ্ট্র

0
117

তথাকথিত গণতন্ত্রের কথা বললেও গত এক যুগে র‌্যাব ও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধীদল ও মতের মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেফতারের পর তথাকথিত ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনা এখন আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে ইতোমধ্যেই আমেরিকা র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবির হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে ইসলামপন্থী নেতাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা অতীতের সব নিকৃষ্ট পন্থাকে ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগীরা। আটকের পর রিমান্ডের নামে তাদের ওপর চালানো হয়েছে বর্বর নির্যাতন। কারো কারো হাত-পায়ের সব নখ তুলে নেওয়া হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে এসবের মোটেই তোয়াক্কা করেন না শেখ হাসিনার সরকার।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিএনপি, হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহ সব বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা।

ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে শুরু থেকেই জঙ্গি কার্ড ব্যবহার করে “গুয়ান্তানামো বে” এর আদলে ওয়াটার বোর্ডিং টর্চার করে র‌্যাব-পুলিশ ও ডিবি।

আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ।

র‌্যাব ও পুলিশ হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আমার দেশ ইউকে’ র কাছে তুলে ধরেছেন নির্যাতনের ভয়াবহতা।

কেইস স্টাডি: ১- র‌্যাবে ভয়াবহ ওয়াটার বোর্ডিং টর্চার

ইসলামপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আবদুর রহমান (ছদ্ম নাম)। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি মামলায় তাকে আটক করে র‌্যাব। র‌্যাব-২ এর মোহাম্মদপুরের বসিলা ক্যাম্পে সেই তরুণকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

ওই তরুণ এখন জামিনে মুক্ত। আমার দেশ -কে তিনি রিমান্ডে তার ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন।

ওই ব্যক্তি বলেন, “র‌্যাব -২ এর বসিলা ক্যাম্পে রিমান্ডে আনার পর শুরু থেকেই আমার ওপর ভয়াবহ নির্যাতন করে তারা। প্রথমেই কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। হাত দুটো পেছনে নিয়ে পরানো হয় হাতকড়া। এরপর মারতে মারতে আমাকে নেয়া হয় ছোট্ট একটি বাথরুমে। সেখানে চোখ বাঁধা থাকলেও হাতকড়া খুলে ফ্লোরে শুইয়ে ফেলে। এরপর চারজন আমার হাত-পা শক্ত করে ধরে রাখে। অন্য একজন তাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে মুখে একটি কাপড় গুঁজে দেয়া হয়। এরপরই মুখে ও নাকে পানি ঢালতে শুরু করে তারা। তখন দম বন্ধ হবার অবস্থা। এভাবে মিনিট দশেক নির্যাতন চলে। এই অবস্থাতেই নানান প্রশ্ন করতে থাকেন একজন।”

তিনি আরো বলেন, “এরপর পানির সঙ্গে শুকনা মরিচের গুড়া মিশিয়ে ফের মুখে, নাকে ও কালো কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় চোখে ঢালতে থাকে। এতে ভয়াবহ যন্ত্রণা শুরু হয়। এভাবে থেমে থেমে পানি ঢালতে থাকে তারা। মনে হচ্ছিল আমি এখনই মরে যাব। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। নাক, চোখ তীব্র জ্বালাপোড়া করছিলো।”

ওই তরুণ যখন এসব বলছিলেন তখন তাঁর চোখে মুখে ভেসে উঠে ভয়ের চিত্র। তিনি বলেন, “পানিতে মরিচের গুড়া একবারই মিশিয়ে এভাবে আনুমানিক ১০ মিনিট নির্যাতন চালায় তারা।”

“এরপর আরো মিনিট বিশেক মুখে, নাকে পানি ঢালতে থাকে আর নানান প্রশ্ন করতে থাকে।
দ্বিতীয় দিন নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তারা। একই কায়দায় টানা ৪০ মিনিটের মতো বাথরুমে ফেলে নাকে, মুখে পানি ঢালতে থাকে। নির্যাতন সইতে না পেরে আমি কয়েকবার বমি করি। আমার অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তারা ভয় পেয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে কথাবর্তায় তাদের ভয় বুঝতে পারি আমি। তখন তারা আমাকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রাতেই নিয়ে যায়। আমার অবস্থা বেশি ভাল না হওয়ায় এরপর আর নির্যাতন করে নাই তারা। এমনকি রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হবার আগেই তারা আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।”

কেইস স্টাডি: ২: চোখ বেঁধে স্পর্শকাতর জায়গায় বৈদ্যুতিক শক

সালেহ আহমেদ (ছদ্ম নাম)। বয়স আনুমানিক ত্রিশ। তরুণ গ্রেফতারের পর র‌্যাবের হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন আমার দেশকে।

“আমি সহ ৪ জনকে একটি মেস থেকে গ্রেফতার করেছিল র‌্যাব-২। গ্রেফতারের পর মেসের ভেতরেই চেয়ারে বেঁধে প্রথমেই বেদম পেটায় তারা। এরপর তাদের মাইক্রোতে তুলে কানের লতিতে কোনো এক ডিভাইস দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। ইলেকট্রিক শকে আমার বমি হওয়ার মতো অবস্থা। ভয়াবহ পেইনফুল অবস্থা ছিল সেটা।”

তিনি বলেন, “আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় র‌্যাব -১ এর টিএফআই সেলে। সেখানে ঝুলিয়ে পায়ের তলায়, গিরায়, মাংস পেশিতে বেদম পেটায়। সেই নির্যাতনের পর থেকে এখনও মাঝেমধ্যে ভয়াবহ ব্যাকপেইন শুরু হয়।” এই কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এ তরুণ।

কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা গলায় বলেন, “র‌্যাব-১ এ আমাদের সবাইকে শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছিল। এভাবে ৪ দিন টানা আমাদের ওপর নির্যাতন চালায় তারা। চোখ বেঁধে সারাক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখতো। বসতে দিতো না। ঘুমাতে দিতো না। এছাড়া সব সময় তারা এক ধরনের আতঙ্ক তৈরী করে রাখতো।“

তিনি আরো বলেন, “নতুন নতুন ফরমেটে টর্চারের আবহ তৈরী করে রাখতো। এমন অবস্থায় আমি আতঙ্কিত থাকতাম। সেখানে দফায় দফায় শক দেয়া হয়েছিল। দিনরাতের পার্থক্য বুঝতাম না। কারণ সব সময় চোখ বেঁধে রাখতো। নামাজের অনুরোধ করলে মাঝে মধ্য পড়তে দিতো।”

এই তরুণদের মতোই একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি এবং বিভিন্ন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরকে পদ্ধতিগতভাবে দমন করার নিকৃষ্ট চেষ্টা করছে শেখ হাসিনার সরকার।

সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় গ্রেফতার ও বিচার করা, আদালতে যথাসময়ে উপস্থাপন না করে গোপন সেলে আটক রাখা, বার বার জামিন প্রত্যাখ্যান করে অন্যায়ভাবে কারাবন্দী রাখা, পরিবারের সদস্যদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, প্রতারণা ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী নিয়ে দোষী সাব্যস্ত করা শেখ হাসিনার সরকারের নিত্যনৈমিত্তিক দমন-নিপীড়নের কিছু উদাহরণ মাত্র।

রিমান্ডে নিয়ে বৈদ্যুতিক শক এবং ওয়াটার বোর্ডিংয়ের মতো নিষিদ্ধ ও ভয়াবহ নির্যাতনের দৃষ্টান্তও এই জালিম সরকার স্থাপন করেছে।

যদিও বাংলাদেশের দলদাস গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশ হচ্ছে না বা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন সাংবাদিকেরা।

সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা উন্মোচন, ভারতকে ট্রানজিট প্রদানসহ বিভিন্ন সামরিক চুক্তি, বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পদ ও সামরিক বাহিনীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টাইগার সার্কসহ বিভিন্ন যৌথ সামরিক মহড়া এবং টিকফা, আকসার মতো অসম চুক্তির বিরোধীতা করায় ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর নিপীড়ন দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি মূলত বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই আইনের সাথে ন্যায়বিচারের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া বার বার রিমান্ড মঞ্জুর করে ইসলামপন্থীদেরকে নির্যাতনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ছেড়ে দেয়া, কিংবা জামিন না-মঞ্জুর করে মাসের পর মাস কারাবন্দী রাখা হচ্ছে।

এদিকে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে কিছুদিন পরপরই জঙ্গি কার্ড ব্যবহার করছে শেখ হাসিনা।

প্রকৃতপক্ষে, সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের কার্ড ব্যবহার করে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ঠেকানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত শেখ হাসিনার সরকার।

নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, পিটিয়ে হত্যা:

সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কূটচাল করে ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ওপর। বিএনপির একের পর এক নেতাদেরকে বিভিন্ন সাজানো মামলায় গ্রেফতারের পর চালানো হয় ভয়াবহ নিপীড়ন। নিপীড়ন সইতে না পেরে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছেন বিএনপির এক সময়ের জনপ্রিয় নেতা নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু, শ্রমিক নেতা বিএম বাকির হোসেন।

সেনাবাহিনীর সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব) রেজাকুল হায়দার চৌধুরীকে , ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল। রেজাকুল হায়দার চৌধুরীর নখ উপড়ে ফেলাসহ অসহ্য নির্যাতন চালানোর কথা কারাগার থেকে জানিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির চেহারা উন্মোচন এবং মানুষের অধিকারের পক্ষে কলম ধরায় আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকেও গ্রেফতারের পর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল। জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আমার দেশ ছাপাখানা।

একই ধরনের নির্মম নির্যাতন করে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের কাছ থেকে। মুফতি হান্নানকে “গুয়ান্তানামো বে” এর আদলে ওয়াটার বোর্ডিং, নখ উপড়ে ফেলা, হাতুড়ি দিয়ে পেটানো এবং বৈদ্যুতিক শক দিয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জবানবন্দি আদায় করার বর্ণনা লিখিতভাবে আদালতকে জানিয়েছিলেন। এই জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলেন আদালতে।

একই ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছিল বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকেও।

হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক, মুফতি ইজহার সহ কয়েক ডজন বিখ্যাত ও সম্মানিত আলেমকেও নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করার উপক্রম করা হয়েছে। মাসের পর মাস অনেক আলেমকে কারাগারে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে।

গোপনে ধরে আনলে কাকপক্ষীও টের পাবে না:

জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত জুরাইনের অধিবাসী মিজানুর রহমানকে চলতি বছরের (২০২২) ৯ই জুন ঢাকার জুরাইন রেলগেট সংলগ্ন একটি মার্কেট থেকে ‘তুলে নেয়’ শ্যামপুর থানা পুলিশ। শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে একজন নারী অফিসার তাকে ধমক ও গালি-গালাজ দিয়ে কথা বললেন। নারী কর্মকর্তার নির্দেশে তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। ওসির রুমে অফিসারদের একজন আরেক জনকে বলছিলেন, “স্যার ও তো বিএনপির কমিটির লোক।” আরেকজন বলছে, “স্যার ওরা তো পরিবারসুদ্ধা আন্দোলন করে। মেয়েরাও আন্দোলন করে।” তখন থানার কোনো এক অফিসার বলছে, “ওইগুলারেও তুইল্যা নিয়া আয়।”

এরপর তাঁকে চোখ বেঁধে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখানে এক সিনিয়র কর্মকর্তা বললেন, “ধরেন আপনি একটা মামলা খেলেন। মামলা তো নানাভাবেই দেওয়া যায়। ধরেন আপনাকে কেউ ২ পিস, ৫ পিস, ১০পিস ইয়াবা ঢুকায় দিয়ে মামলা দিয়ে দিল। মামলায় ধরেন ২০ বছর পর রায় হলো। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। যারা আপনার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে তারাও জানে আপনি নির্দোষ। কিন্তু এই ২০ বছরের জার্নি আপনি চিন্তা করেন তো।”

এভাবে ৩ ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন চলে তাঁর ওপর। তাকে নেয়া হয় পাশের অন্য কক্ষে। সেখানে পানি খেতে চাইলে বলা হয়, ‘রোজা থাকেন।’

মিজানুর বলেন, ‘আমার স্ত্রী যখন (ডিবি কার্যালয়ে) গেলেন তাকে আমার সামনেই বলা হলো, “আমরা তো ওনাকে সবার সামনে দিয়ে নিয়ে আসছি। যদি গোপনে ধরে নিয়ে যাই, কাকপক্ষীও টের পাবে না, তখন কি করবেন?”

মিজানুরকে ভাগ্যবানই বলতে হয়। কারণ থানা থেকে ডিবি পর্যন্ত তাঁর ওপর যে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে, তার কাছে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট কিশোরের ওপর চালানো নির্যাতন তো একদমই নস্যি। চলুন কার্টুনিস্ট কিশোরের ওপর নির্যাতনের ঘটনা আবার স্মরণ করি।

ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন:

২০২০ সালের ২রা মে কার্টুনিস্ট কিশোরকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গ্রেপ্তার দেখানোর আগে ‘অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়।

মুক্তির পর কার্টুনিস্ট কিশোর গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘তারা আমার চোখ বেঁধে ফেলে। হাতকড়া পরিয়ে আমাকে একটি গাড়িতে তোলা হয়। প্রায় ৪২–৪৩ মিনিট চলার পর গাড়িটি থামে। তারা আমাকে একটি ভেজা, স্যাঁতসেঁতে কক্ষে নিয়ে যায়। ওই কক্ষে পেট্রলের তীব্র গন্ধ ছিল। আমাকে সেখানে ছয় ঘণ্টা রাখা হয়। যখনই চোখে বাঁধা কাপড় খুলতে গেলাম, ঠিক তখনই কয়েকজন সেখানে এসে আমাকে মারতে শুরু করে। তারা আমাকে হুমকি দেয়, আমি যদি এমন কাজ আবার করি, তাহলে আমাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। তারা আমাকে পিঠমোড়া করে হাতকড়া পরায়।’

‘আরও ঘণ্টা ছয়েক পর তারা আমাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায়। এটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখানে আমি সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ পাই। কিছুক্ষণ পর আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় আমার আঁকা কার্টুন একের পর এক দেখানো হয়। প্রশ্ন করে, আমি এগুলো কেন এঁকেছি? কার্টুনে থাকা একটি দুর্নীতিবাজ চরিত্র দেখিয়ে বলে, এটি কে? এরপর আবারও শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন।’

এই নির্যাতনের একপর্যায়ে মাথায় ও ডান কানে আঘাত করা হয় জানিয়ে আহমেদ কবির কিশোর বলেন, ‘তীব্র ব্যথায় আমি কঁকিয়ে উঠি। বুঝতে পারি, গরম কিছু কান বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু হাতকড়া পরা থাকায় স্পর্শ করতে পারিনি। আমি কাঁদতে শুরু করি। অসহায়ভাবে চিৎকার করি। তাতেও তাদের মন গলেনি। বন্ধ হয়নি শারীরিক নির্যাতন। আমাকে বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে সেখানে গিয়ে শার্টে রক্ত দেখতে পাই। বাথরুমের মেঝেতেও তাজা রক্ত ছিল। এর অর্থ, আমার আগে সেখানে অন্য কাউকে নির্যাতন করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘৫ মে বিকেল নাগাদ লেখক মুশতাক ভাই সহ আমাদের দুজনকে খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ওই সময় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় আমি বেশ কাতর ছিলাম। মুশতাক ভাই আমাকে হাসিমুখে থাকতে বলেন। তিনি বলেন, “আমরা কোনো অন্যায় করিনি। তাহলে এমন হতাশ থাকব কেন?” পরে মুশতাক ভাই আমাকে বলেন, তাঁকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। ওই সময় আমরা পাশের কক্ষ থেকে আরও মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। সেখান থেকে চলে আসার সময় আমরা মেঝেতে রক্ত আর নোংরা পানি দেখেছিলাম।’

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩:

২০১৩ সালে এই আইন প্রণয়ন করা হলেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেই চলেছেন শেখ হাসিনা। ফলে গত এক যুগে বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে হাজার হাজার মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যা করা হয়েছে।

নিউ ইয়র্কে ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। ওই সনদের অংশীদার হিসেবেই নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল।

এতে বলা হয়েছে, ‘‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং যেহেতু জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়নের দাবি করে৷’’

কিন্তু, এই আইনের তোয়াক্কা তো সরকার করছেই না, বরং ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ বাতিলে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছিল পুলিশ। একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এলে বিচারিক আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন বলে আদালত সম্প্রতি যে রায় দিয়েছেন, সেটি পুলিশের অধিকারকে খর্ব করছে বলেও ২০১৭ সালে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনার কাছে দাবি করা হয়েছিল। সেই সময় আইজিপি ছিলেন এ কে এম শহীদুল হক।

বাংলাদেশে এই আইনে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি মামলার বিচারের উদাহরণ আছে৷ মামলাও হয়েছে অনেক কম৷ ২০১৩ সালে আইনটি পাশ হওয়ার পর ২০১৪ সালে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় জনি নামে এক ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মারা যান৷ তার পরিবার এই আইনে মামলা দায়ের করেন৷ ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালত পল্লবী থানার তখনকার এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এসআই রশিদুল ইসলাম এবং এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুসহ এই তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ তাদের দুইজন সোর্সকে দেয়া হয় সাত বছরের কারাদণ্ড৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here