রাষ্ট্রীয় গুম খুনের অন্যতম হোতা হারুন অর রশীদ হলেন ডিবি প্রধান

0
118

গুম, খুন ও বিরোধী নেতাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন ও চাঁদাবাজির অভিযোগে কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান করা হয়েছে। তার এই পদায়নের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ বুধবার (১৩ জুলাই) এ আদেশ জারি করেছে।

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নে এবং বিরোধী দল দমনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীর ভূমিকা পালনকারী এই পুলিশ অফিসার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য একের পর এক পুরস্কৃত হয়েছেন। দলবাজ এই পুলিশ কর্মকর্তা গত বছরের মে মাসে যুগ্ম কমিশনার হিসেবে গোয়েন্দা বিভাগে পদায়ন হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে ঘুরে ফিরে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশেই পোস্টিং দেয়া হয়। তিনি ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এবং নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন।

২০১১ সালে সংসদের তৎকালীন বিরোধীদল বিএনপির হরতাল চলাকালে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে রাস্তায় বেদম পিটিয়ে আলোচনায় আসেন মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। রাজপথে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চীফ হুইপকে মারধরের পুরস্কার হিসাবে শেখ হাসিনা সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় পুলিশ পদক দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। বিগত গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সময়ও ওই জেলার পুলিশ সুপার থাকার সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি।

ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজ:

হারুনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠলেও তার প্রভাবের কারণে কেউ কিছু বলতে পারেননি। বরং অভিযোগ থাকার পরও সব সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন।

হারুনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ (রাসেল)। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় শওকত আজিজ রাসেলকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরে তাঁরা মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।

ওই ঘটনার বিবরণ দিয়ে শওকত আজিজ তখন গণমাধ্যমকে বলেন, চাঁদা নিয়ে হারুন অর রশীদের সঙ্গে তার পুরোনো বিরোধ ছিল। সম্প্রতি তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নতুন একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন। সেখানেও হারুন ঝামেলা বাঁধাচ্ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩১শে অক্টোবর তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে একটি পার্টিতে নামিয়ে ঢাকা ক্লাবে আসেন। ক্লাব থেকে বেরিয়ে দেখেন তাঁর গাড়িটি নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন গাড়ি আছে নারায়ণগঞ্জে। পরদিন রাতে তার অনুপস্থিতিতে হারুন একদল পুলিশ নিয়ে তাঁর গুলশানের বাসায় ঢুকে ভাঙচুর করেন। এরপর তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যান। এ বিষয়ে নিকটস্থ গুলশান থানাকে কিছু জানায়নি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ। পরদিন তাঁর খোয়া যাওয়া গাড়িতে ইয়াবা, মদ ও গুলি উদ্ধারের ঘটনা সাজিয়ে তাঁর ও তাঁর গাড়িচালকের নামে মামলা করেন। গুলশানের বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও শওকত তাঁর ফেসবুকে শেয়ার করেন।

তবে শওকত আজিজের স্ত্রী-পুত্রকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মিথ্যা গল্প শুনিয়েছিলেন হারুন। তিনি মিথ্যা দাবি করেছিলেন যে, শওকত আজিজের গাড়ি থেকে ২৮টি গুলি, ১ হাজার ২০০ ইয়াবা বড়ি, ২৪ বোতল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ, ৪৮ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে। ওই সময় গাড়িতে শওকতের স্ত্রী ফারাহ রাসেল ও সন্তান আনাব আজিজ ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের আটক করা হয়েছিল। পরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এম এ হাসেম সহযোগিতা করবেন বলে মুচলেকা দেওয়ায় তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

শওকত আজিজ তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, হারুনের চাঁদাবাজি নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে তিনি একটি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশনের আদেশে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহারের পর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তাঁর কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। তাঁর পক্ষে উপপরিদর্শক আজহারুল ইসলাম আম্বার ডেনিমের স্টোর ম্যানেজার ইয়াহিয়া বাবুকে ফোন করে টাকা দাবি করেন। এর আগেও গুলশান ক্লাবের লামডা হলে ও গুলশানের কাবাব ফ্যাক্টরি রেস্তোরাঁয় হারুন তাঁকে ডেকে নিয়ে ৫ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের ৪৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গাজীপুর থানায় ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়।

শুধু শওকত আজিজই নন, গত ২৭ অক্টোবর রাতে হারুনের লোকেরা আরও একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও তাঁর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে গুলশান থেকে তুলে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আটকে রাখেন। পরে জার্মানপ্রবাসী একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা এবং পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুরোধে শিল্পপতিকে ছেড়ে দিলেও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

কিন্তু, শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ সখ্য থাকার কারণে একের পর এক অপকর্ম করলেও তাকে বারবার গুরুত্বপূর্ণ পদেই বসাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।

দুদকও অসহায়:

বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে নভেম্বর মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ জমা দেন সালেহ উদ্দিন নামের সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। এসপি হারুনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনেন সেই আইনজীবী।

কিন্তু, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই অভিযোগও ধামাচাপা দেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এই পুলিশ কর্মকর্তা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাকে ভয় করেন?

পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেমের ছেলের স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নেয়ার ঘটনার পর ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেই সময় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একপর্যায়ে এসপি হারুন সালাম দিতেই মুখের ভঙ্গি বদলে যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। অসন্তোষসুলভ ভঙ্গিতে মাথাও নাড়েন আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তখন এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, উনার (এসপি হারুন) ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে যে, উনি চাঁদাবাজি করছিলেন, একজনকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না- এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেখুন, তিনি উঠিয়ে নিয়ে গেছেন, নাকি কী করেছেন, এটা তো তদন্তের ব্যাপার। তদন্তের আগে আমরা কী বলব তিনি অপরাধ করেছেন? তদন্তের পরই আমরা এগুলো খোলাসা করে বলতে পারব।

তদন্ত কী শুরু করেছেন- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘সেটা তো শুরু হবেই, আমরা মাত্রই তো তাকে সরিয়ে আনছি।’

কিন্তু, এরপর সেই তদন্ত আর এগোয়নি। বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরবর্তীতে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তিনি পদায়ন পেয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here