অলিউল্লাহ নোমান
দেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম সহযোগী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। শেখ হাসিনার অনুগত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার। এটি শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে। জেনারেল মঈন উদ্দিনের জরুরী আইনের সরকার সমঝোতার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর উদ্যোগ নেয়। তখন নির্বাচন কমিশন ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করে বিশাল বিজয় দেয়।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে এই সমঝোতার মধ্যস্থতা করেছিল ভারত। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, দুই শর্তে মঈন উদ্দিনে শেখ হাসিনার কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়েছিলেন। এরমধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে তাঁর চাকুরির মেয়াদ পর্যন্ত সেনা প্রধান পদে বহাল থাকা এবং আরেকটি হচ্ছে সেনা প্রধানের পদ থেকে অবসরে গেলে কোন কিছুর জন্য বিচারের আওতায় না এনে নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়া। ব্যক্তিগত স্বার্থে একজন সেনাপ্রধান ভারতের সাথে সমঝোতা করে একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই কাজটিতে মূল সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন নির্বাচন কমিশন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সমঝোতার নির্বাচনের দায়িত্বটি পালন করেছিলেন সাবেক আমলা এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিশন। জরুরী আইনের সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ টি এম শামসুল হুদাকে প্রধান নির্বাচক কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হাল আমলে সুশীল হিসাবে পরিচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন ও সাবেক জেলা জজ ছহুল হোসাইন। ছহুল হোসাইনে পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন সিলেটের একটি আসন থেকে। এই কমিশনই প্রথম মানুষের ভোটের অধিকার অবজ্ঞা করে পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী নিজেদের সাজানো ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে পরবর্তীতে নিজের মত করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মাধ্যমে সাজানো ও লোক দেখানো সংলাপের মাধ্যমে শেখ হাসিনার অনুগত অবসরপ্রাপ্ত আমলা রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি লোক দেখানো একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। এই নির্বাচনে ১৫৪ আসনে ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয় এই আসন গুলো। বাকী গুলোতে নির্বাচনের নামে শেখ হাসিনার সিলেক্টেড ব্যক্তিদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। মূলত মানুষের ভোটের অধিকার পুরোপুরি হরণে সহযোগিতা করেন রকিবউদ্দীন কমিশন।
এই কমিশনের পর আবারো লোক দেখানো সংলাপের মাধ্যমে সাবেক আমলা কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে গঠন করা হয় নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের নির্বাচন। এ নির্বাচনে মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকেই শুধু বঞ্চিত হয়নি, বিরোধী দল অংশ নিলেও তাদের প্রার্থীদের প্রচারণার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ভোটের দিন কেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হয়নি বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের এজেন্ট। ভোটের আগের রাতেই ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসী ও পুলিশকে দিয়ে ব্যালটে সীল দেওয়ার কাজটি সেরে নেন নুরুল হুদা কমিশন। রাতেই ব্যালটে সীল দিয়ে বিজয় নিশ্চিত করার মত জঘন্য কাজের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিকে ধ্বংসের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেয় এই কমিশন।
আগামী ৭ জানুয়ারি আরো একটি সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে সহায়তা করতে এই নির্বাচনটিও পূর্ব পরিকল্পিত নির্ধারিত ফলাফলের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
নুরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর শেখ হাসিনা অতি বিশ্বস্ত কাজী হাবিবুল আওয়ালকে দেওয়া হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্বে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে সারা দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার ফন্দি আঁটেন। চার দিক থেকে কঠোর সমালোচনার এক পর্যায়ে এই প্রকল্প থেকে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এই বিভিন্ন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি তিনি বহাল করছেন। সর্বশেষ শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় রাখতে বিরোধী দল গুলোর দাবী উপেক্ষা করে একতরফা তফসিল ঘোষণা করেছেন কাজী হাবিবুল আওয়াল। এই তফসিলের মাধ্যমে মূলত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় রাখতেই সকল প্রকার প্রচেষ্টা বলে মনে করে দেশের মানুষ।