ফেরার এক পিতার করুণ আর্তনাদ- ছেলে, মেয়ের সঙ্গে দেখা নেই ১৪ বছর। গুমরে কান্নাই তার সম্বল। বলেন, ফেরার সময়ে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কদাচিৎ ভিডিও কলে কথা হয়। তাও ক্ষণিকের জন্য। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রহমান সুমন।
ফেরার এক পিতার করুণ আর্তনাদ- ছেলে, মেয়ের সঙ্গে দেখা নেই ১৪ বছর। গুমরে কান্নাই তার সম্বল। বলেন, ফেরার সময়ে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কদাচিৎ ভিডিও কলে কথা হয়। তাও ক্ষণিকের জন্য। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রহমান সুমন।
পরিবারের কে কখন কোথায় যান, পুলিশ তারও খোঁজ রাখে। ফোনে কথা পর্যন্ত বলতে পারি না। ফোন ব্যবহার করলেই পুলিশ পিছু নেয়। প্রতিদিনই আমার বাসায় পুলিশ যায়। এলাকায় পুলিশের অনেক ফর্মা কাজ করে। পুলিশের চেয়ে এই ফর্মারা বেশি ভয়ঙ্কর। বাবার জানাজায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি। যেতে পারিনি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও আমাকে খোঁজে। পুলিশের তাড়ায় ঢাকায় থাকতে পারি না। ৪ বছর দুই জেলায় আত্মগোপনে ছিলাম। অনেক কষ্টে জীবন কাটিয়েছি। নিজের বাড়ি থাকতেও ৯ বছর বাড়িতে যেতে পারি না। ভোটের অধিকারের সংগ্রামে নেমে জীবন থেকে ১০টি বছর হারিয়ে গেছে।
রামপুরা থানা যুবদলের আহ্বায়ক কামাল আহমেদ দুলু। গত সোমবার ঢাকার সিএমএম আদালতে সংবাদ মাধ্যমে এই কথা বলেন তিনি। বলেন, একের পর এক মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে দিন কাটে আদালতে। রামপুরা, খিলগাঁও, হাতিরঝিল থানায় মামলা হলেই আমার নাম থাকে। আমি একজন কমন আসামি। এমন কোনো মামলা নেই, যেখানে আমার নাম নেই। আমি কোন চোরাবালিতে আটকে গেছি নিজেই বলতে পারি না। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ওপর ভর করেই জীবন চলছে। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ৯ বছরে ৭৩টি মামলা হয়েছে। খিলগাঁও থানায় ১৭, রামপুরা ৩৭, হাতিঝিল ২, রমনা ১, শাহবাগ থানায় ২টি মামলা হয়েছে। মামলার পেছনে দৌড়ে এখনো সংসার করা হয়নি। এলাকায়ই যেতে পারি না। বিয়ে করবো কীভাবে? এমন একটা অনিশ্চিত জীবন হলে তার সঙ্গে কে মেয়ে দিবে? আসলে এই জীবনের কোনো অর্থই হয় না।
তিনি বলেন, কয়েকটি মামলার বিচার শুরু হয়েছে। মামলার কারণে এখন ঢাকায় থাকতে হয়। ঢাকায় একটা মেসে থাকি। প্রতিদিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এমন কোনো দিন নাই, যেদিন আদালতে আসতে হয় না। এখন আদালতই আমার ঠিকানা। সাজা হলে কারাগারে যেতে হবে।
রাজনৈতিক মামলা নিয়ে একই রকম পেরেশানিতে হাবিবুর রহমান সুমন। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রামপুরা উলন বাজার এলাকার বাসিন্দা। রামপুরা, হাতিরঝিল, খিলগাঁও, রমনা, শাহবাগ, পল্টন ও খিলক্ষেত থানায় সুমনের নামে ১৩৫টি মামলা আছে। অনেক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। ২০১০ সালের পরে হওয়া ২০টি মামলার বিচার শুরু হয়েছে। তবে তিনি আদালতে যান না। মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও খোঁজখবর রাখেন না। আগে হাজিরা দিতে নিয়মিত আদালতে যেতেন। ৩ বছর ধরে আর যান না। বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকতে হয়। ২০১০ সালের পরে আর বাড়িতে যেতে পারেননি সুমন। সুমনের বাসায় প্রায়ই পুলিশ আসে। তার সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। সুমন বলেন, ১৪ বছর ধরে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারি না। আমি এক অভাগা পিতা। কয়েকদিন আগে আমার মেয়ে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। বাবা তুমি কি আমাকে কখনো স্কুলে নিয়ে গেছো। তখন আমি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। ফোন কেটে দিয়ে নীরবে কেঁদেছি। আল্লাহ একদিন এই কান্নার বিচার করবে। দেশে থেকে ছেলে-সন্তান পরিবারের কাছে না যেতে পারার চেয়ে যন্ত্রণার কিছু নাই। এই যন্ত্রণা ১৪ বছর ধরেই বয়ে বেড়াচ্ছি। কষ্টের বিষয় হলো পুলিশ আমার পরিবারের সদস্যদেরও নজরদারিতে রাখে। তারাও ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। মাস খানেক আগে আমি এক আত্মীয়র বাসায় বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই, বাসা থেকে বের হওয়ার পরেই পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। এই হলো আমাদের জীবন।
আরেক ভুক্তভোগী আদিবুল হক আল আমিন। রামপুরা থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি। পশ্চিম রামপুরা মহিলা কমিউনিটি সেন্টার গলি এলাকার বাসিন্দা। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশ তার বাসায় গিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে এলাকায় যেতে পারেন না আল আমিন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না সরাসরি। পরিবারও নানা কষ্টে আছে। রামপুরাসহ বিভিন্ন থানায় আল আমিনের নামে প্রায় ৬০টি মামলা আছে। ২০২১ সালে আল আমিনের বাবা মারা গেলে তিনি বাবার জানাজায় যেতে পারেননি। ভয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ করতে পারেন না। মাঝেমধ্যে অন্যের ফোন দিয়ে কথা বলেন।
অনিকুর রহমান জাফর। হাতিরঝিল থানা ছাত্রদলের সভাপতি। রামপুরার পূর্ব উলন এলাকার বাসিন্দা। নাশকতা, ভাঙচুর ও পুলিশের কাজে বাধা প্রদানের জন্য অন্তত ৬০টি মামলার আসামি জাফর। একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ২০১৩ সাল থেকে এলাকায় যেতে পারেন না। পরিবারের সঙ্গে দেখাও করতে পারেন না। দেশে থেকেও প্রবাসীর মতো জীবন পার করছেন তিনি।
আসিফ সাত্তার শোভন। বাসা পূর্ব রামপুরায়। তিনি রামপুরা থানা যুবদলের সদস্য সচিব। ৭ বছর ধরে এলাকাছাড়া। নিয়মিত বাসায় পুলিশ যায়। এলাকায় শোভনের খোঁজ করেন পুলিশ সদস্যরা। রামপুরা, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহবাগ থানায় ৫১টি মামলা আছে শোভনের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে দীর্ঘদিন ধরেই নিজ এলাকায় যেতে পারেন না। প্রায়ই পুলিশ বাসায় এসে তার খোঁজ করে। পরিবারের সদস্যদেরও চাপ দেয় শোভনের অবস্থান জানাতে। তবে প্রায় দুই বছর ধরে তিনি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করেছেন। পুলিশি হয়রানি এড়াতেই ঢাকা ছেড়েছিলেন। তবে সম্প্রতি মামলাগুলোর বিচার শুরু হওয়ায় প্রতিদিনই আদালতে যেতে হয়। তাই ঢাকার একটি মেসে থেকেই সকালে আদালতে আসেন আর রাতে মেসে ফিরেন।