সাইবার সন্ত্রাসীদের দাপটে তটস্থ অনলাইন ব্যবহারকারীরা

0
50

অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে সাইবার সন্ত্রাসীরা নানা কিসিমের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। নিত্যনতুন কায়দায় অপরাধের শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে এসে অভিযোগ করছেন। আর এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাক, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল ভিডিও ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল, অনলাইন হ্যারেসমেন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা, বিভিন্ন অ্যাপসে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া, মানহানিকর মিথ্যা বক্তব্য প্রচারসহ আরও বিভিন্ন ধরনের অপরাধের অভিযোগ প্রতিনিয়ত আসছে। নানাভাবে সাইবার হ্যারেসমেন্টের শিকার ভুক্তভোগীরা সাইবার সন্ত্রাসীদের দাপটে তটস্থ হয়ে আছে। অনেক সময় এসব অপরাধীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও রেহাই মিলছে না। প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিয়েও তারা ভুক্তভোগীকে ছাড় দিচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাইবার অপরাধীরা এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেও মানুষকে ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করছে। হাতিয়ে নিচ্ছে  লাখ লাখ টাকা। এআই দিয়ে নারীদের বেশি টার্গেট করা হচ্ছে। বছরে প্রায় ১০ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এ।

অভিযোগগুলোর মধ্যে ডক্সিংয়ের ৩৮ শতাংশ। ডক্সিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীরা চাইলে একজন অনলাইন ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য, বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর, ক্রেডিট কার্ড নম্বর, ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের আইডি হ্যাক ১৯ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইলিং ১৭ শতাংশ এবং ছদ্মবেশে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে ১০ শতাংশ,  সাইবার বুলিং ৮ শতাংশ এবং আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানো ও মোবাইল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ আছে ৪ শতাংশ। গত এক বছরে যারা অভিযোগ করেছেন তাদের মধ্যে ১৪ ভাগই ১৮ বছরের নিচে। ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১৮ ভাগ। আর ১০ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি। ভুক্তভোগী নারীদের ৩৩ ভাগই ঢাকার বাসিন্দা। চট্টগ্রামে বাস করেন ১৫ ভাগ এবং খুলনায় থাকেন ১২ ভাগ ভিকটিম। এ ছাড়া বরিশাল ও রংপুর বিভাগ থেকে ৮ ভাগ এবং ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে ৬ ভাগ নারী অভিযোগ করেছেন।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) ২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিদায়ী বছরে এই বিভাগটি ৮৫টি সাইবার মামলার তদন্ত করেছে। এসব মামলার মধ্যে ফেসবুক ও অন্যান্য হ্যাকিংয়ের মামলা ছিল ১০.৫৮ শতাংশ, পর্নোগ্রাফি ধারণ ও অনলাইন হ্যারেসমেন্টের ২৪.৭০ শতাংশ, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ১.১৭ শতাংশ, অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা ৪২.৩৫ শতাংশ,  মানহানিকর বক্তব্য ও মিথ্যা তথ্য প্রচারে ১১.৭৬ শতাংশ এবং অন্যান্য সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ৯.৪১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা ও মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্তে। আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পর্নোগ্রাফি ধারণ  ও অনলাইন হ্যারেসমেন্টে।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ দক্ষিণের ২০২৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই বিভাগটিতে ফেসবুক সংক্রান্ত ৩৩০টি জিডির মধ্যে ১৯৬টি মুলতবি ও ১৩৪টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আর্থিক প্রতারণা সংশ্লিষ্ট ২৪৬টি জিডির মধ্যে ১৫৫টি মুলতবি ও ৯১টি নিষ্পত্তি, হ্যাকিং সংক্রান্ত  ২৫৮টি জিডির ২৫৮টি মুলতবি ও ১৭১টি নিষ্পত্তি, পর্নোগ্রাফির ৫০টি’র মধ্যে  ২৬টি মুলতবি ও ২৪টি নিষ্পত্তি, ব্ল্যাকমেইল সংক্রান্ত ১০১টি জিডির মধ্যে ৬১টি মুলতবি ও ৪০টি নিষ্পত্তি, অন্যান্য সাইবার অপরাধের ১০২টি জিডির মধ্যে ৬৪টি মুলতবি ও ৩৮টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এই বিভাগে  মোট ১২৫৮টি জিডির মধ্যে ৭৬০টি মুলতবি ও ৪৯৮টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএএফ) প্রতি বছর সাইবার ক্রাইমের শিকার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে মাঠপর্যায়ের একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের মাত্রা বেড়েছে।

সিসিএফ’র ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়াই বছরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল অপরাধ বিভাগের ৪০৬টি মামলার তথ্য অনুযায়ী ব্যবহারকারীর অজান্তে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছেই। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার ফাঁদে ফেলার মাধ্যমে প্রতারণা। আবার দামি রেস্তরাঁয় খাবারের ভুয়া ফরমাশ দেয়াসহ নানা কায়দায় মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র।  ডিএমপির ৪০৬টি মামলার মধ্যে অনলাইন প্রতারণার মামলাই ৯৮টি, যা মোট মামলার প্রায় ২৪ দশিমক ১৩ শতাংশ।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ও অপারেশনের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সাইবার স্পেসটা একটা বড় জায়গা। তার কোনো সীমা পরিসীমা নাই। সাইবার স্পেসে আমরা প্রয়োজনের তাগিদে বা যোগাযোগের জন্য যখন সক্রিয় হই তখন সচেতনতাটা খুবই জরুরি। স্যোসাল মিডিয়ার যেসব অ্যাপস আমরা ব্যবহার করি সেগুলো কীভাবে নিরাপদ রাখা যায় তার গাইডলাইন ফলো করতে হবে। অনেকেই টেকনোলজি ব্যবহার করে কিন্তু এটাকে কীভাবে নিরাপদ রাখতে হবে সে বিষয়ে সচেতন থাকে না। এজন্য আমরা যেসব পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি সেটি কঠিন করে দিতে হবে। দুর্বল করে দিলে সেটিকেই কাজে লাগাবে হ্যাকারর।

তিনি বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের অ্যাপস আসতেছে। আমরা না বুঝে যাঁচাই-বাছাই করে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছি। আমরা তাকে চিনি না, কিন্তু একটা অ্যাপসকে বিশ্বাস করে আমরা বিনিয়োগ করছি। একটা সময় আমরা হয়তো বুঝতে পারি প্রতারণার শিকার হয়েছি ততক্ষণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া অনেকে ফিশিং লিংক পাঠিয়ে ফাঁদ পাতছে। সেগুলোতে না বুঝে এগুলোতে ক্লিক করা যাবে না। আর এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন যখনই বুঝবেন তখনই পুলিশকে ইনফর্ম করতে হবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে পুলিশ সহজেই তাদের ধরতে পারে। কারণ একটা সময় অপরাধীরা সব তথ্য মুছে ফেলে। তিনি বলেন, অনলাইন কেনাকাটার বিষয়ে ক্রেতারা যে পেইজ থেকে পণ্য কিনবে সেটি ভুয়া পেইজ না অরিজিনাল পেইজ সেটি খেয়াল রাখতে হবে। পেইজে যে নম্বরগুলো দেয়া আছে সেগুলো যাচাই করতে হবে। ডিরেক্ট ফোনে কথা বলছে কিনা বা আগ্রহী কিনা সেটি দেখতে হবে। কারণ প্রতারকরা হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে কথা বলতে চাইবে। তাই অনলাইন কেনাকাটার জন্য ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য কিরতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here