সংকটে বাংলাদেশ; নুরুল কবীরের পর্যবেক্ষণ

0
98

কার্যত বাংলাদেশের জন্ম হয়- ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ৫২ বছর আগে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের বিজয়ী জনগণের মধ্যে যে গভীর আশা এবং মহান প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা নতুন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে এখন পুনঃউৎপাদন করা সত্যিই খুব কঠিন। তথাপি, ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রাক্কালে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কর্তৃক প্রকাশিত ঢাকাভিত্তিক সাময়িকী ” প্রতিরোধ “ এর সম্পাদকীয় থেকে কয়েকটি লাইন এর উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্পাদকীয়তে লেখা ছিল,

“ ঢাকা শহর মুক্ত হতে যাচ্ছে । অগণিত মৃত্যু, কঠোর প্রতিরোধ এবং রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের বিনিময়ে বিজয়ী জনগণ এখন শহরটিকে ঘিরে রেখেছে। ঢাকা শহর, যেটি একটা সময় জন্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের শক্ত ঘাঁটি এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের আস্তানা ছিল, এখন ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু ঢাকা শহর, যা আবার বাঙ্গালির বিপ্লবের দুর্গ, প্রতিবাদী পতাকার শহর, চির বিদ্রোহী, তা এখন আনন্দে নেচে উঠছে। ঢাকা শহরের সম্মান অটুট থাকুক, এর ভাবমূর্তি কখনো কলঙ্কিত না হোক, কারোর কাছে মাথা নত না হোক। মুক্তিযোদ্ধারা বীরদর্পে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা বিভিন্ন দিক থেকে শহরে প্রবেশ করছেন এবং তাদের সঙ্গে শহরে প্রবেশ করছে কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খা, তাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের বিপ্লব। এই বিপ্লব কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, বরং সব বাঙালিরই- বাঙালি জনতা রক্ত ঝরিয়ে, প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এর সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছে। এই সত্য অনুধাবন করা জরুরি, বিশেষ করে ঢাকার স্বাধীনতার প্রাক্কালে বিদেশী দখলদার থেকে মুক্তি হলো স্বাধীনতার অর্জনের প্রথম পর্যায় এবং এর চূড়ান্ত লক্ষ্য দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ”

 

সম্পাদকীয়তে যে স্বপ্ন, যে আশা প্রকাশ পেয়েছিল তা ভিত্তিহীন নয়। পাকিস্তান শাসনের জন্য পূর্ব-পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ) আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যান্ডেটকে পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) অস্বীকৃতি এবং প্রচলিত বৈষম্য দূর করার জন্য পূর্ব-পকিস্তানের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পূর্বে পাকিস্তানে নৃশংস সামরিক ক্র্যাকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এছাড়াও, আওয়ামী লীগের যুদ্ধকালীন নির্বাসিত সরকার (মুজিবনগর সরকার) কর্তৃক প্রণীত স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় জনগণকে দেশের মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছিল, প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে শুধুমাত্র একটি ‘জনগণের প্রজাতন্ত্রই’ গঠন করা হবে না বরংএকটি স্বাধীন দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করা হবে । এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ‘সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা’ নিশ্চিত করা হবে।

কিন্তু, আফসোস, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির ৫২ বছর পর এসে শাসকশ্রেণীর বহুমাত্রিক দেউলিয়াত্বের কারণে, সহজ ভাষায় বাংলাদেশের জনগণ, বৃহত্তরভাবে, একটি রাজনৈতিক মূর্খতাপূর্ণ ব্যবস্থা তথাপি রাজনৈতিক মরণব্যাধির সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে বিগত পাঁচ দশকে শাসকগোষ্ঠী যে প্রজাতন্ত্র গড়ে তুলেছে এবং নিজেদের ক্ষুদ্র শ্রেণী স্বার্থকে রক্ষা করতে রাষ্ট্রকে যে ভাবে ব্যবহার ও অপব্যবহার করেছে তা জনগণকে ব্যাপক অর্থে আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে ও সংস্কৃতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ করেছে , এবং এটা যারা করেছে তাদের মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতার সফল যুদ্ধে লড়াই করা গর্বিত বাংলাদেশিরাও আছেন।

শাসক শ্রেণীর মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি এখনও একটি অবাধ ,সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক নির্বাচনী ব্যবস্থা বিকশিত ও তৈরী করতে সক্ষম হয়নি । ফলশ্রুতিতে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধি, এমনকি জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারছে না। যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন না হয়, যা অনেক দূরের কথা বলে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের যে কোনো স্তরে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায় না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে দেশের শাসক শ্রেণীর বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক শিবিরগুলি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মিমাংসার পথে গিয়ে নিজেদের বিকশিত করতে পেরেছিল। এবং দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দ্বারা অনুমোদিত, ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তিন মাসের জন্য,একটি নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যা সামাজিকভাবে সম্মানিত নির্দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে হবে , বেসরকারীভাবে গঠিত হয়েছিলো । এটিকে সংবিধানের মধ্যে এনে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য আওয়ামী লীগের একের পর এক অত্যন্ত সহিংস আন্দোলনের পর অবশেষে “ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল “ রাষ্ট্রের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯৬ সালে। সিস্টেমটি কয়েকটি মেয়াদে কাজও করেছিল এবং জনগণ সাধারণভাবে নির্দলীয়, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন সিস্টেমটিকে তার অনুকূলে পরিচালনা করার জন্য কিছু নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালায় , অবশেষে দুই বছরের জন্য পশ্চিমা-চালিত একটি সামরিক-সমর্থিত অবৈধ সরকার দ্বারা অধিগ্রহণের ফলে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে ২০০৮ সালে । তারপর, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখন সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, প্রকাশ্যে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, ২০১১ সালে একটি পরাধীন বা আজ্ঞাবহ আদালত ব্যবস্থার অপব্যবহার করে এক তরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সরিয়ে দেয়, যা দুটি রাজনৈতিকদলের দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের পথ প্রশস্ত করে এবং তা কীভাবে এবং কখন শেষ হবে তা কেউ জানে না।

এদিকে, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষপাত মূলক তত্ত্বাবধানে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা সমগ্র বিরোধী দলের পাশাপাশি বেশিরভাগ ভোটার দ্বারা বয়কট করা হয়েছিল। শাসকদের ৩০০-সদস্যের জাতীয় সংসদের জন্য ১৫৪ জনের মতো ‘নির্বাচিত’ হয়েছিল ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছাড়াই এবং বাকিরা প্রায় ১০ শতাংশ ভোটারের ভোটে নির্বাচিত হন। দেশের জনগন ‘ভোটবিহীন নির্বাচনের’ মাধ্যমে গঠিত রাজনৈতিকভাবে অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধী বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু ততক্ষণে, ক্ষমতাসীনরা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের উপর জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে এবং বিভিন্ন উপায়ে, ন্যায্য ও অন্যায্যভাবে এমনভাবে পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে যা নির্মমভাবে প্রতিবাদ দমন করে এরপর এলো ২০১৮ সালের নির্বাচন এবং এবারে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষপাতমূলক ব্যাবস্থাপনায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিরোধীদের প্রতি এটি অঙ্গীকার করেছিল যে, এবার অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল জনগণের ও তাদের কাছে ক্ষমতাসীনদের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রেখে অবশেষে সরল বিশ্বাসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু, আফসোস, দেশ সবচেয়ে কলঙ্কজনক নির্বাচনের সাক্ষী হয়েছে, যেখানে ভোটের দিনের আগের রাতে বেশিরভাগ আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ভোটে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পোষ্য দল জাতীয় পার্টিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দল করা হলেও বিএনপির মাত্র পাঁচ প্রার্থীকে জয়ী হতে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণভাবে প্রতারিত, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং তার মিত্ররা আওয়ামী লীগকে কখনোই বিশ্বাস না করার সংকল্প করে এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি অন্তর্বর্তী, নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের বিধান পুনরুদ্ধারের জন্য এখনও রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি নিজস্ব স্টাইলের নির্বাচন করতে প্রস্তুত, যেখানে বিএনপির বেশিরভাগ নেতা এবং হাজার হাজার নেতৃস্থানীয় বিরোধী কর্মীদের কারাগারে এবং বাকিরা পুলিশি আক্রমণের মুখে পলাতক , ফাঁসানো মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কোনও বিরোধী দল না থাকায়, আওয়ামী লীগ বিশ্বকে দেখানোর জন্য নির্বাচনে “ডামি প্রার্থী “ দাড় করাচ্ছে । লীগের নির্বাচনী প্রতীকসহ অন্যরা বিভিন্ন প্রতিক নিয়ে নির্বাচনে নামছেন। অন্যদিকে, আ.লীগ তার নেতৃত্বে ছোট মিত্র দলের মধ্যে কিছু ‘আসন’ বণ্টনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে । এদিকে জোটের দলগুলি, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা থেকে বরাদ্দকৃত আসনের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য, তাদের প্রার্থীদের প্রত্যাহারের জন্য আওয়ামী লীগকে কঠোরভাবে চাপ দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মতো এর শরিকরাও নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নারাজ। নির্বাচন নিয়ে কী প্রহসন আর কী রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মাত্রা! জনমনে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ইতিমধ্যেই “ডামি নির্বাচন” নামধারণ করেছে। এইভাবে একটি ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’ কাজ করে না, বিকাশ লাভ করা তো দূরে থাক।

আবার, ধারাবাহিক ভাবে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলি (রাষ্ট্রের) ক্ষমতার পৃথকীকরণ নিশ্চিত করতে পারেনি, এক কথায়, রাষ্ট্রের নির্বাহী শাখা থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করতে পারেনি। একই ব্যক্তিকে আইনত অনুমতি দেওয়া হয়েছে আইনসভার প্রধান, নির্বাহী বিভাগের প্রধান এবং ক্ষমতাসীন দলের পদের থেকে সবকিছুর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য । বিচার বিভাগ কার্যত সরকারের সাথে একীভূত থাকাতে ন্যায়বিচার প্রয়োগ ব্যবস্থার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- একজন রাজনীতিবিদ কিছু দিন আগে পর্যন্ত বিরোধী দলের একজন ছিলেন , সহিংসতার অপরাধের দায়ে অভিযুক্তও ছিলেন, এবং সেইজন্য, গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ হন। তিনি ক্ষমতাসীনদলে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেই আদালত জামিনে মুক্ত দেন এবং একই অপরাধে অভিযুক্ত তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জেলে থাকছেন। তাদের বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অন্যদের কারাগারে থাকা ঘটনাটি যথেষ্টভাবে আইনের শাসনের চিত্রকে প্রকাশিত করছে। এছাড়াও, অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য পুলিশ ফৌজদারি মামলা তৈরি করছে বিরোধীদলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে । বিভিন্ন ধরণের ‘ফৌজদারি অপরাধে’ অভিযুক্ত শত শত বিরোধীদলীয় কর্মী ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, পক্ষপাত দুষ্ট সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সাজা দেয়া হচ্ছে। এমনকি ‘আইনের শাসনের প্রাথমিক নজিরও এখানে লক্ষ্য করা যায় না এবং কোন একটা ছদ্ম-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও –এই ধরণের বিচারিক অনুশীলনের অনুমতি দেয় না, কারণ এটি আইনবিভাগ ও নির্বাহীবিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূল গণতান্ত্রিক নীতি বর্জিত। তদুপরি, পুলিশ রাজনৈতিকভাবে নিরপরাধ পিতামাতা, বা সন্তান, এমনকি স্ত্রীদেরকে তুলে নিয়ে আটকে রাখার উদাহরণ তৈরি করছে, যাদের বেশির ভাগকেই এমনসব ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে- তারা গ্রেপ্তারের আওতায়ই আসার কথা না । এই যদি হয় ‘আইনের শাসন, তাহলে ‘জঙ্গলের শাসন’কী? এই অবস্তাকে প্রবাদে বলে “ জোড় যার, মুল্লুক তার “।

 

এই শাসক শ্রেণী একটি সমতাভিত্তিক জাতীয় অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যার্থ হয়েছে – যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রতিশ্রুতি। পরিবর্তে, স্বাধীনতার পর থেকে বিগত পাঁচ দশকে, ধারাবাহিক ভাবে সরকারগুলি একটি ‘ ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ গড়ে তুলেছে মানে একটা সবচেয়ে খারাপ ধরনের পুঁজিবাদী বিকাশ যা অবাধ ভাবে ব্যবসায়ীদের অসাধু অংশ, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং ক্ষমতার কাছাকাছি রাজনীতিবিদদের সুবিধাবাদী অংশেকে আরও সুবিধা, সেবা বা খিদমত প্রদান করার জন্য ব্যবহার করা হয় , স্পষ্টতই প্রান্তিক লাখ লাখ মানুষের বিশাল বঞ্চনার মূল্যে এটা করা হয়। কথাকথিত ‘দেশপ্রেমিক’ ধনীদের এই অংশটিই বিভিন্ন উপায়ে সরকারি কোষাগার লুণ্ঠন করে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের খেলাপি করা, বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্বিগুণ বা এমনকি তিনগুণ খরচ দেখানো যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলিতে আরো কম ব্যয় হয়। এটি ক্রনি ক্যাপিটালিজম দ্বারা সৃষ্ট, যার সদস্যরা তাদের প্রিয় বিদেশী গন্তব্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেখে আসে যার হিসাব করা অকল্পনীয় বিষয় যা প্রয়োজনীয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শুকিয়ে দিতে ভূমিকা রাখে।

 

দেশের মেহনতি কৃষক, যারা জাতির জন্য খাদ্য উৎপাদনকারী, রপ্তানি খাতের কঠোর পরিশ্রমী শিল্প শ্রমিকরা অত্যধিক প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে এবং দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিকরা, রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বৈদেশিক মুদ্রা এই দেশেই পাঠায়, এবং এইভাবেই জাতীয় অর্থনীতি চলমান রয়েছে, ‘জাতীয়’ অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের আশা-আকাঙ্খাকে খুব কমই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের কোন কিছু বলার সুযোগও রাখা হয়নি। এটিই ক্রনি পুঁজিবাদ যেটির মাধ্যমে লুন্ঠনকারী ধনীশ্রেণীরা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, যারা জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। দমনমূলক রাষ্ট্র যা নাগরিকদের জন্য সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারকে অস্বীকার করে এবং একটি কুৎসিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা একটি অশ্লীল ও নোংরা পরিস্থিতি তৈরি করে, সমাজে আয়ের বৈষম্য তৈরী করে। এটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ, অসামঞ্জস্যিক- নাগরিকদের জন্য নিশ্চিত করতে পারে নাই- ‘সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা।

বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্ব জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতেও অক্ষম বা অনিচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে, যেমন বিদেশী হস্তক্ষেপ সহ্য করা, বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে। ভারতের সাথে সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, একজন মন্ত্রী এটাকে ‘স্ত্রী এবং স্বামী’ সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন । উপরন্তু, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে সক্ষতাও রাখে এই নেতৃত্ব যা তার রাজনৈতিক ভাবে টিকে থাকার বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ায়। এই বৈদেশিক নীতিগুলি বাংলাদেশকে চীন ও পশ্চিমের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধের মুখোমুখি করে তুলছে বারংবার। ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতার কালে দলটির গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রামের নজির থাকলেও, এখন সরকারের পদক্ষেপগুলি নাগরিকদের আশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ক্ষমতাসীন দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ঐতিহাসিক বয়ান প্রচার করে, ভিন্নমতের কণ্ঠকে দমন করে এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করে চলেছে।

 

ইতিমধ্যে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ক্ষমতার বাইরের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, উপেক্ষিত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে। লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একটি কার্যকর জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে এবং তাঁদের এই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই আন্দোলন দমনে ভয়াবহ নিপীড়িন করা হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা লীগের কর্তৃত্ববাদী সরকার দ্বারা জবরদস্তিমূলক আচরণের শিকার হচ্চে। যাইহোক, গণতন্ত্র অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ বিরোধী দল কোনও দেবদূত নয়, কারণ এটির অধিকাংশ সদস্য কর্তৃত্ববাদী সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আচরণের ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে, কিন্তু স্পষ্টতই তা আ.লীগের তুলনায় নগন্য। আ. লীগ বর্তমানে জনগণের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে এবং তারা এখন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শাসন-শোসন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, জাতীয়তাবাদী দল, এবার তার মিত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির চাপের মুখে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের একটি দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেছে, কিন্তু তার নেতৃত্ব এই কর্মসূচির প্রচারে অনিচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। স্পষ্টভাবে তারা বলেছে না যে পার্টি ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র ও অর্থনীতির গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য জনগণের স্বার্থে জাতীয়তাবাদী দল কি ধরণের পদক্ষেপ নিবে। তাদের কর্মসূচিসমূহেকে জনগনের কাছে যথেষ্ট পরিস্কার না করার অভিপ্রায় কোন শুভ বার্তা দেয় না।

অতএব প্রকৃত গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশে একটি নতুন ‘জনগণের প্রজাতন্ত্রের’ আহ্বান জানানো হচ্ছে। যেটাকে আমরা দ্বিতীয় রিপাবলিক বলছি। স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্পিরিটকে বাস্তবায়নের জন্য এর কোন বিকল্প নাই। রাষ্ট্র গঠনের এই কাজ স্বাধীনতার ৫২ বছরেও করা হয় নাই। জনগনের উপর কোন কিছু চাপিয়ে না দিয়ে জনগনের ইচ্ছার আলোকে সংবিধান প্রণয়ন করার মাধ্যমে এই কাজের সূচনা করতে হবে। এটি অর্জনের জন্য একটি গণপরিষদের মাধ্যমে সাংবিধানিক পুনর্লিখন প্রয়োজন, যা বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের জন্মের আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করতে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি নতুন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার মধ্যে অতীতের ব্যর্থতার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এবং পরবর্তী প্রজাতন্ত্র গঠনে অন্যান্য জাতির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এটি করতে ব্যর্থ হলে একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা স্থায়ী হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here