ষোল আনাই মিছে

0
9

মামুন খান

মারা গেছে জান্নাতারা বেগম। তার মরদেহ গলা থেকে পা পর্যন্ত লাল সবুজ কাফনে মোড়া শুধু মুখমণ্ডল উন্মুক্ত। খাটিয়ায় না নিয়ে তাকে চ্যাং দোলা করে কবরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লাল-সবুজ কাফন এবং চ্যাং দোলা করে লাশ বহন- এ দুটোই জান্নাতারার কাছে অভিনব এবং আপত্তিকর। সে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ করছে, বলতে চাইছে মৃত হিসেবে তাকে তার ন্যূনতম মর্যাদাটুকু অন্তত দেওয়া হোক। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করছে না। পরিচিত, অপরিচিত অনেকেই তার চ্যাং দোলা শবযাত্রার আগে পিছে হাঁটছে। সবার হাতে একটা করে স্মার্ট ফোন। সবাই ব্যস্ত ব্রাউজিং এ- আল্লাহ্‌ খোদার নাম কেউ নিচ্ছে না।

কে একজন চেঁচিয়ে বলল, সবাই রেডি? উই আর ইন লাইভ না’ও। বাকি সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল, আহা বেশ, বেশ, বেশ! কে লাইভ করছে তা’ বোঝা যাচ্ছে না, তবে জনপ্রিয় একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কণ্ঠই মনে হচ্ছে। লাইভ শবযাত্রার ধারাভাষ্যকার তার স্বভাবজাত সুললিত কন্ঠে বলছে- শুভ সকাল বন্ধুরা। টরন্টোর বাংলা কমিউনিটির প্রিয় মুখ, আমাদের প্রাণপ্রিয় জান্নাতারা বেগমের অনন্ত যাত্রার লাইভ টেলেকাস্টে সব্বাইকে স্বাগত। বাইরে Temperature এখন হিমাংকের সামান্য উপরে। ধবল বকের পালকের ন্যায় শুভ্র তুষারে ছেয়ে আছে চারিধার, সেই সাথে নৃত্যের তালে তালে——- এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার দর্শক শ্রোতা যোগ দিয়েছেন আমাদের লাইভ শব যাত্রায়।

এতক্ষণ যা বলছিলাম, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ঝিরি ঝিরি তুষার পাত হচ্ছে, ঠিক যেন ধবল পরীদের নৃত্য। এরই মাঝে জাতীয় পতাকা কাফনে মোড়া জান্নাতারার মরদেহ দৃপ্ত প্রত্যয়ের সাথে ধীর লয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আপনারা যারা প্রোগ্রামটি লাইভ দেখছেন তাদের কাছে নিশ্চয়ই দৃশ্যমান হচ্ছে- সাদা তুষার আর সাথে লাল সবুজ। রঙের কী অসাধারণ কম্বিনেশন, বর্ণনাতীত, অভূতপূর্ব, অমায়িক করুন এক দৃশ্য।

এক ফাঁকে খাটো মত কেউ এক একজন সেলফি তুলল তার সাথে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে তার নিজের হাতেও একটা ডিভাইস, মরার আগ আগ দিয়ে কিনেছিল- আই ফোন ১১প্রো। তা’ ফোন থাকলেই বা কি যায় আসে? কবরেতো ওয়াইফাই (WiFi) নাই। আর ওয়াইফাই থাকলেও পাসওয়ার্ড তো জানে কেবল হুজুররা।

টুং করে একটি শব্দ হল ইমোজি আসার। দাঁত ক্যালানো হাসির imoji দেখতে পেল জান্নাত ফোনের মনিটরে। যাক নেটওয়ার্ক আছে তাহলে। কিন্তু লাশের সাথে মস্করা কে করল? খুবই নাখোশ হয় জান্নাত। এরা মানুষ হবে কবে, মরলে পরে? গালি দিতে মন চায় তার। লাশের পক্ষ থেকে গালি দেওয়া বারণ বিধায় এই কর্মটি থেকে নিজেকে বিরত রাখলো। তবে সে জিন্দাদের নসিহতের উদ্দেশ্য বলল, ওহে জগতের মানবকুল, মরে আগে আমার মত মুর্দা হউ, তারপর বুঝবা কত মরিচে কত ঝাল।

এমন সময় ফোন বেজে উঠল। হ্যালো, গায়েবি কণ্ঠে কেউ একজন উত্তর দিলো। কণ্ঠটা তার খুব চেনা মনে হচ্ছে। আরে! এ তো নসুর গলা। নওশের ওরফে নসু- তার একমাত্র হাজব্যান্ড। কিন্তু ওকে দেখা যাচ্ছে না কেন? চিৎকার করে সাহায্য চায় সে- নসু, তুমি কোথায়? হেল্প মি, প্লীজ। গলা দিয়ে চিৎকার বেরোয় না। শুধু গোঙ্গানির মত শব্দ বেরোয়।

ধারাবিবরণী হঠাৎ থেমে গেল। হেই ও, হেই ও করে তার চ্যাং দোলা দেহ খানি দোলনার মত আগ পিছ বার কয়েক দুলিয়ে শূন্যে ছেড়ে দিল শব বহনকারীরা। ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করল সে। তবে চিৎকারের শব্দ বের হলো না, কেমন যেন গোঙ্গানির মত শব্দ হলো মাত্র। ক্ষণকাল পরে চোখ খুলে জান্নাত নিজেকে আবিষ্কার করল কবরে, সামনে দাঁড়ানো পাহাড়ের মত উঁচু এক দানব, হাতে তার বিশাল মুগুর। ভয়ে ভয়ে দানবের চেহারা পরখ করার প্রয়াস চালায় সে।

খুব চেনা চেনা মনে মনে হচ্ছে, কার মত যেন দেখতে, কার মত যেন! ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, এতো দেখি Rodney, তার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। মানুষ হিসেবে মন্দ না। মন্দের মধ্যে শুধু মাঝে মাঝে তার হো হো অট্টহাসিতে পুরো বিল্ডিং প্রকম্পিত হয়। আর সেই সময় আশে পাশে অধঃস্তন যারা থাকে তাদেরকেও তার চেয়ে লোয়ার স্কেলে হো, হো বা হি হি করে হাসতে হয়। গেল রোজার ঈদে আস্ত এক বাটি সেমাই এনে খাওয়ালো সে রডনিকে। চেটে পুটে খেয়ে সে কী খুশি রডনি। কবরের ভয়াবহ জীবনে রডনির মত একজন পুরোপুরি না হলেও মাঝারি মানের ভাল মানুষের দেখা পেয়ে ভয় অনেকটা কেটে গেল জান্নাতের।

ইংরেজিতে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করল জান্নাত, রডনি, হাউ কাম ইউ আর হিয়ার? হোয়াট’স দ্যাট ইন ইওর হ্যান্ড?

-এটা দিয়ে তোমাকে বানানো হবে। এটাকে বলে মুগুর, বাংলায় উত্তর দিল রডনি।

-একি, তুমি দেখি চোস্ত বাংলা জানো।

-বাংলা, উর্দু, হিন্দি, হিব্রু সব ভাষাই আমার জানা। শুধু চাইনিজটা জানিনা। হো, হো, হো- – – ,রডনির অট্টহাসিতে কবর প্রকম্পিত হয়।

-প্লীজ রডনি। ঘন দুধের সেমাইর দোহাই লাগে তুমি আমাকে মেরো না, আর্তি জানালো জান্নাত। দূর থেকে বিউগলের সুর বেজে ওঠল। এখনই হয়ত তোপধ্বনি শুরু হবে। মনে মনে প্রীত হল জান্নাত- যাক তাকে তাহলে জাতীয় মর্যাদায় দাফন করা হচ্ছে।

গায়েবি নকিব ঘোষণা দেয়, Attention!

সটান হয়ে দাঁড়ায় রডনি।

-মুগুর মারতে হবে। মুগু—র মার।

এবারে ব্যাক গ্রাউন্ডে অর্কেস্ট্রা আর ব্যান্ডপার্টি বেজে ওঠে একসাথে। পূব আর পশ্চিমা মিউজিকের ফিউশন। সেই সাথে কোরাসে গণ সঙ্গীত:
যেমন কুকুর, তেমন মুগুর।

ঘোরাও মুগুর, মারো কুকুর।।

সংগীত চলার মধ্যেই রডনি দুই হাতে মুগুর উঁচু করল। তারপর বিশেষ কায়দায় তিনশ ষাট (৩৬০) ডিগ্রী এঙ্গেলে মুগুরটিকে ঘোরায় বার কয়েক- সাঁ সাঁ । যেন হাইওয়েতে দুইশ কিলোমিটার বেগে স্পোর্টস কার ছুটে চলছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিল জান্নাত। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না- আগের মত শুধুই গোঙ্গানি।

বুম! সজোরে আঘাত হানে রডনির মুগুর। চোখ, মুখ, নাক, ঘিলু, খুলে সব চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।

ওঠো, ওঠো– — , সেই গায়েবি আওয়াজ।

নাক, মুখ, খুলি, ঘিলু যে যার জায়গায় একসাথে হয়ে আবার পূর্ণ জান্নাতের আকার ধারণ করলো। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল সে। সামনে দাঁড়ানো ছোট, খাটো একজন চাইনিজ। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কে যেন, কে যেন! ও হ্যাঁ চিনেছে। ওর নাম Walt.

যদিও এটা তার আসল নাম না। চাইনিজ নামের ক্যানাডিয়ান ভার্সন। নিরেট ভদ্রলোক। গেল সামারে জান্নাতদের সুইমিং পুল ক্লিন করেছিল ওয়াল্ট। ভাগ্যিস পৃথিবীতে থাকতে চাইনিজ ভাষায় কিছুদিন তা’লিম নিয়েছিল সে। এখন মোক্ষম এস্তেমাল করা যাবে।

-নি হাউ ওয়াল্ট ( হাই ওয়াল্ট), হাওজিউ বুজিয়ান ( লং টাইম নো সী)– পুরোটা শেষ করতে পারে না সে, বুম ম!

-ওঠো, ওঠো, সেই সাথে মৃদু ধাক্কা।

ধড়মড় করে শোয়া থেকে উঠে বসে জান্নাত।

-এত জোরে নাক ডাকছো? এবার একটু ক্ষান্ত দাও দয়া করে। আর ঘুমানোর আগে ফেইস বুক থেকে লগ আউট হয়ে ঘুমাতে যেও প্লীজ। টুং টাং করে সারাক্ষণ শুধু – – –

অন্য যে কোন সময় হলে সামান্য একটু নাক ডাকার অপরাধে শান্তির নিদ্রায় ব্যত্যয় ঘটানোর জন্য আর ফেইস বুকিং নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য রাখার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় একটা মামলা ঠুকে দিত জান্নাত। তা হোক না বিবাদী তার আপন স্বামী। কিন্তু এই মুহূর্তে তৃতীয় বারের মত মুগুর পেটা থেকে রক্ষা করার জন্য স্বামীর প্রতি অন্তরটা ভক্তি ভরে সিক্ত হয়ে উঠল। তবে মুখে শুধু ছোট্ট করে বলল, সরি।

মাথার কাছে জানালাটা খোলা থাকায় সোঁ সোঁ শব্দ আসছে হাইওয়ে থেকে। উঠে জানলা বন্ধ করে পাশ ফিরে শোয় জান্নাত। ইতোমধ্যে উপযুক্ত অর্ধাঙ্গ হিসেবে স্বীয় স্ত্রীর অসমাপ্ত নিদ্রা এবং নাক ডাকা দুটো কর্মকেই অবশিষ্ট রজনী চালিয়ে নেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করল নওশের। কখনও মৃদু, কখনও বা মাঝারি আবার কখনও বা ভারি মাত্রায় নাসিকা গর্জনে বাকি রাত ঘর প্রকম্পিত হতে থাকলো। সেই সাথে ঢুস ঢাস বায়ু নির্গমন- স্বপ্নে যা তোপধ্বনি মনে হচ্ছিল।

বলাই বাহুল্য অবশিষ্ট রজনী বিছানায় এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম কাটিয়ে দিল জান্নাতারা বেগম। সেই নির্ঘুমতার পেছনে নওশেরের নাসিকা গর্জন যতটুকু না দায়ী, তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী মৃত্যু ভয়।

জান্নাতের স্বপ্নে এমন বিভীষিকাময় ঘটনার অনুপ্রবেশের পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে।

চলবে – – – –

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here