তিন মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে টিকার জন্য কেন্দ্রে অপেক্ষা করছিলেন শিশুটির বাবা আক্তার হোসেন। গত দু’সপ্তাহ ঘুরে ইপিআই তথা সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির টিকা দিতে এসেও শিশুটিকে টিকা দেয়াতে পারেননি তিনি। গতকাল রাজধানীর পুরান ঢাকার হাজারীবাগ পার্কের পাশে অবস্থিত নগর মাতৃসদন কেন্দ্রে টিকার জন্য আধা ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করেন তিনি। কিন্তু টিকা মিলেনি। হতাশ হয়ে বাসায় ফেরেন শিশুটির বাবা। সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও উদ্বিগ্ন এই অভিভাবক। সরজমিন এই প্রতিবেদনকে জানান, শিশুটি ৩টি টিকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পেয়েছে মাত্র ১টি। টিকার সংকটের কারণে টিকা দেয়া হচ্ছে না বলে কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে তাকে। একই কেন্দ্রে তিন মাসের আরেক শিশু নিয়ে টিকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আরেক পিতা।
তিনিও একই অভিযোগ করলেন। বললেন, গত সপ্তাহের বুধবারও এসে টিকা দেয়াতে পারেননি তার সন্তানকে। তিনি বলেন, দেশ এভাবে শিশুকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ৭নং বড়কুল পশ্চিম ইউনিয়নের শিশু ইয়াসিন। বয়স ৪ মাস। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে টিকা পাওয়ার কথা থাকলেও টিকা পায়নি শিশুটি। ডিসেম্বর মাসে এসেও পেয়েছে মাত্র ১টি টিকা। পাওয়ার কথা ছিল ৩টি। শিশুটির বাবা এখন টিকা নিয়ে ব্যাপক উদ্বিগ্ন।ইপিআই তথা সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কেন্দ্রীয় সূত্র জানায়, শুধু রাজধানী বা চাঁদপুর নয় দেশের কিছু কিছু জায়গায় শিশুদের টিকার সংকট রয়েছে। এজন্য শিশুরা নিয়মিত টিকা পাচ্ছে না। তবে যেসব টিকা পায়নি ওইসব টিকা পরেও দেয়া যাবে। শিশুদের টিকা আগে নেয়া যায় না। গ্যাভি থেকে আগামী ৩রা জানুয়ারির মধ্যে টিকা চলে আসবে বলেও দাবি করছে সূত্রটি।
ইপিআই শিশুদের দেয়া টিকার সংকট রয়েছে। এ টিকা সংকট শিশুকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলেছে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। ইপিআই’র অধীনে শিশু জন্মের ৬, ১০ ও ১৪ সপ্তাহে তাকে ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি ও হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি জনিত রোগ প্রতিরোধে বিনামূল্যে টিকা দেয়া হয়।
শিশুরা নিয়মিত টিকা না পেলে কী হতে পারে জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (কোভিড) অন্যতম সদস্য, শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যাবে। তাদের এমিউনিটি তৈরি হবে না। অর্থাৎ যে শিশুটি নিয়মিত যে রোগের টিকা পাওয়ার কথা ছিল তা না পেলে ওই অসুখে সে ভুগবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক মাত্রায় ও সময়ে না দেয়া গেলে শিশুর শরীরে টিকাগুলোর কার্যকারিতা থাকে না। এতে শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, সমগ্র জাতিকেই খেসারত দিতে হয়। একদিকে ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি’র ন্যায় প্রাণঘাতী রোগের কারণে বহু সম্ভাবনাময় প্রাণ অঙ্কুরেই ঝরে যায়। অন্যদিকে পোলিও এবং ডিপথেরিয়ার ন্যায় রোগের পরিণামে পঙ্গুত্ব বরণ করায় শিশুটি কালক্রমে পরিবার ও জাতির জন্যই এক প্রকার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুর ছয়টি সংক্রামক রোগের (উপর্যুক্ত পাঁচটি রোগ ও যক্ষ্মা) টিকা দেয়ার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহায়তায় ১৯৭৯ সালের ৭ই এপ্রিল ইপিআই শুরু হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বে অনন্য সাফল্য প্রদর্শন করেছে। এর ফলে দেশে শিশু-মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।
জানা গেছে, গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে টিকাকেন্দ্রগুলোয় শিশুদের জন্মের পর ধাপে ধাপে দেয়া টিকা দান কার্যক্রমের (ইপিআই) কিছু টিকা পাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনই অভিভাবকরা তাদের শিশুদের নিয়ে টিকা কেন্দ্রে এসে পুনরায় ফিরে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইপিআই তথা সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর নিজাম উদ্দিন বলেন, দুই তিনটি ভ্যাকসিনের সংকট রয়েছে। আশা করি দ্রুত এই সমস্যা কেটে যাবে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ১টি টিকা বাদে শিশুদের বাকি টিকাগুলো সরকারি এবং বিদেশিদের দেয়া অর্থে কিনা হয়। টিকাগুলো বিদেশ থেকে আসতে মাঝে মাঝে একটু দেরি হয়। তখন টিকায় ঘাটতি দেখা দেয়। তবে যেখানে ঘাটতি থাকে স্টোরে টিকা থাকলে সেখানে সরবরাহ করা হয় ইপিআই থেকে। তিনি আরও জানান, সিটি করপোরেশন এলাকায় টিকা দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। কিন্তু টিকা সরবরাহ করে ইপিআই কেন্দ্রীয় অফিস।