শহরের বাতাসে লাশের পোড়া গন্ধ, দায় কার?

0
69

এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার পর এই শহরে অগ্নি ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় বড় নিরাপত্তা ব্যুহ এতদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়ার পরও পুরনো ঢাকার এখনো অসংখ্য বাড়িতে কেমিক্যাল মজুত রয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্ন থাকে রাষ্ট্রযন্ত্র কি এতটাই দুর্বল যে, শোনাউল্লা শুনে যা আর বকাউল্লা বকে যা- এই অবস্থা। না হলে একেকটি ঘটনার পর নির্দেশ দেয়া হয় কিন্তু ঐ পর্যন্তই। রাজউক বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের দায়িত্ব এই শহরে অনিয়ম চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কই, ব্যবস্থা নেয়া হলে তো বেইলি রোডে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। তারা নীরবে, চোখে কালোপট্টি বেঁধে নোটিশ নামক ফাঁদ তৈরি করে দায়সারা কাজ করবে। যখন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন বলবে আমরা আগেই বলেছি, এই ভবনের রেস্তরাঁ চালাবার অনুমতি ছিল না। আমরা নাগরিকরাও দু’চারদিন দুঃখ করবো, মিডিয়ায় লেখালেখি করবো, টকশোতে গরম গরম কথা বলবো, তারপর যেই লাউ সেই কদু

সামাজিক মাধ্যম স্ক্রল করে যত নিচে যাচ্ছি ততই আটকে যাচ্ছিলাম। পরিচিত অনেকের পোস্টগুলো দম বন্ধ করে দিচ্ছিল।

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সহকর্মী কাজী সুমন আর আঁচলের পোস্টে বুক ভারী হয়ে আসে। সহকর্মীদের কি সান্ত্বনা দেবো? একজনের সহপাঠী, ডেফোডিলের শিক্ষার্থী তুষার হাওলাদার বেইলি রোডের আগুনে ছাই হয়েছে। ১০ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তুষার গাউন পরে মাঠ মাতাবে। তার সেই স্বপ্ন ছাই হয়ে গেল মুহূর্তেই। তার সঙ্গে থাকা সহকর্মী অভিশ্রুতি শাস্ত্রীও প্রাণ হারান। দুজনই ছিলেন সংবাদকর্মী।

আঁচলের মর্মান্তিক স্ট্যাটাসে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সহপাঠী তুষার হাওলাদারের নির্মম মৃত্যুতে সে লিখেছে, ‘তুষার জেএমসি ব্যাচ-৩৯। আমাদের ব্যাচ। একসঙ্গে ধানমণ্ডি থেকে আশুলিয়া ছুটেছি। এতদিনের দৌড়াদৌড়ি শেষে যখন কনভোকেশনের অপেক্ষা তখন এ কেমন আঘাত!! আমরা সহ্য করতে পারতেছি। কেউ কারও জায়গা থেকে ঠিক নাই। সব এলেমেলো হয়ে গেল। কনভোকেশন নিয়ে এত এত প্ল্যান…এত স্বপ্ন সব নিমিষেই ওলটপালট হয়ে গেল!!! তুষার হাওলাদার তোরে ছাড়া কনভোকেশনে কেমনে যাবো!!! কেমনে সবাই হাসব!! আনন্দ করব!!! মানতে পারতেছি না কিছু। কিচ্ছু মানতে পারতেছি না।’

সহকর্মী সুমনের হৃদয় নিংড়ানো স্ট্যাটাস, আমার চাচাতো মামা ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক  হোসেন কাউসার তার স্ত্রী,  দুই কন্যা,  পুত্রসহ সপরিবারে  বেইলি রোডের আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কিছুদিন আগে ইতালির গ্রিনকার্ড  পেয়েছিলেন মামার পরিবারের সদস্যরা। আগামী ২০শে মার্চ পুরো পরিবার নিয়ে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল মামার। ঘাতক আগুন সব কেড়ে নিলো। এই শোক সইবার মতো নয়। আল্লাহ পাক যেন নানু ও আলামিন মামাসহ পরিবারের সবাইকে শোক সইবার ক্ষমতা দেন।

চ্যানেল আইয়ের সহকর্মী শান্ত মাহমুদের দেয়া প্রতিক্রিয়া যেন অনেক কথাই বলে দেয়। ২৯-এর আগুন পোড়া বেইলি রোড শিরোনামে লেখা শোকগাঁথায় তিনি লিখেছেন, আমরা যখন তুমুল আড্ডায় ধানমণ্ডির কনকর্ড আর্কেডিয়ার চার তলায়, তখন দাউ দাউ পুড়ছে বেইলি রোড।
পুড়ছে নিরাপত্তা রক্ষী নাঈম। মাত্র তিনদিন আগে যে তরুণ যোগ দিয়েছিল কাজে। ইচ্ছে ছিল কিছু টাকা জোগাড় করে ভর্তি হবে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাঈমের স্বপ্নের সঙ্গে পুড়ে গেল তার অভাবী পরিবারের স্বপ্নও।

ভিকারুননিসা নূনের শিক্ষিকা বুকের উষ্ণতায় বেড়ে ওঠা মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলেন। বড় আদরের মেয়েকে নিয়ে এই সুখের আসর এত বেশি উত্তপ্ত হয়ে
পুড়িয়ে দেবে তাকে, তার স্বপ্নকে, বুঝেছিলেন কী তিনি? ঐ দূর আকাশের নক্ষত্র হওয়ার আগে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন- ‘মা আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে’। শেষ নিঃশ্বাসটুকু নেয়ার আগে হয়তো কষ্টে নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট বলতে চেয়েছিল- ‘পৃথিবীতে এত বাতাস। এত আলো। প্রভু, আমাদের একটু নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ দাও, আমাদের উত্তাপহীন আলো দাও- নিভে আসছে আমাদের চোখের আলো।’
সংবাদ খুঁজে বেড়ানো তুষার কিংবা অভিশ্রুতি নিজেরাই জন্ম দিলেন তাদের জীবনের শেষ প্যাকেজের। জানতেও পারলেন না, নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে গেল হাজার হাজার টুকরো দৃশ্যকল্প। যা গেঁথে গেঁথে একটা মহাকাব্য লেখা যেত।

বুয়েটের করিডোর ধরে স্বপ্ন বুনে যাওয়া নাহিয়ান আর লামিশাও পুড়ছে তখন আলো ঝলমল বেইলি  রোডে। পুড়ছে তাদের বাবা-মা’র দীর্ঘ অপেক্ষার পর অপূর্ণ স্বপ্ন। একদিন খুব উদাস হয়ে বন্ধুকে বলেছিল নাহিয়ান- এখানে থাকলে হয় একদিন রোড এক্সিডেন্টে মারা যাবো না হয় আগুনে পুড়ে।’ সেই কথাগুলোই সত্য হলো বেইলি  রোডের রাতে।

স্বপ্নের দেশ ইতালি থেকে উড়ে এসেছিলেন যে দম্পতি নিজের  দেশে। দু’দিন পরেই ফেরার কথাও ছিল। দুই ফুটফুটে মেয়ে আর চঞ্চল  ছেলের এমন গর্বিত জনক-জননী নিজেদের বুকে ওদের নিয়ে উড়ে গেলেন অজানা দেশে। ওয়ানওয়ে টিকিট নিয়ে।
মৃত্যুর এই মিছিলে আরও পুড়েছে অজানা কতো মানুষ। আর তাদের অজানা গল্প।
এই মানুষগুলো আমার। না আত্মীয়, না বন্ধু, না স্বজন। কিন্তু স্বজন হারানোর কষ্ট আমাকেও তীব্র শোকে পাথর করেছে আজ।

২৯শে ফেব্রুয়ারি!  চার বছর পর পর তুমি আসো আমাদের স্বপ্ন  পোড়া পৃথিবীতে। এবারও এসেছিলে ইটপাথরের এই শহরে।  তোমার মতো কষ্ট, দুঃখ,  শোকগুলো তো আর প্রকৃতির নিয়মে পুড়ে চার বছর পর পর আসবে না। আমাদের কাছে ওরা আসবে প্রতি মুহূর্তে, প্রতিক্ষণে। আহা! ২৯শে ফেব্রুয়ারি! আহা!

ঘটনার পর থেকেই এক দীর্ঘ বিষাদ সর্বত্র আক্রান্ত করে রেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে কতোটা বিবেকবর্জিত আমরা? মানুষ হিসেবে কতোটা লোভী হলে, শুধু অর্থ উপার্জনই মুখ্য হলে এভাবে জীবন বিপন্ন করতে গ্যাস সিলিন্ডার সিঁড়িতেই রেখে দিতে পারি। বেইলি রোডের ঘটনার পর অনেক কথা হচ্ছে। কি হতে পারতো, কোন সংস্থার দোষ? কারা দায় এড়িয়েছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও শুক্রবার এক বক্তৃতায় স্থপতিদের দুষেছেন। আমি স্থাপত্যশৈলীর তেমন কিছু না জেনে বুঝেও এটুকু বলতে পারি- যারা অনুমতি দিয়েছেন এখানে রেস্তরাঁ চালাবার এর দায় তাদের নিতে হবে। রাজউক ঘটনার পরপরই বলে দিলো তারা আগেই সতর্ক করেছে- প্রশ্ন হচ্ছে এই সংস্থার কর্মকর্তারা কী করে এরকম একটি ভবনে এতগুলো রেস্তরাঁ দিনের পর দিন চালাতে অনুমোদন দিলো। এই ঘটনার পরও ঢাকার বনানী, খিলগাঁও, মিরপুর রোডের মূল রাস্তার ওপর একেকটি ভবনে একাধিক রেস্তরাঁ কী করে এখন অবধি তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে? এর জবাব কি রাজউক দিতে পারবে? নিশ্চয়ই ফের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রাজউক কর্মকর্তারা বলবে এতে রেস্তরাঁ চালাবার অনুমোদন ছিল না। মানুষ মৃত্যুর এই অবৈধ পন্থাকে যারা উপরি নিয়ে বৈধতা দিচ্ছেন তাদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব তো সরকারের। সরকারের একাধিক সংস্থার দায়িত্ব এ ধরনের অবৈধভাবে গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে তালা ঝুলিয়ে দেয়া। এভাবে আগুনে পুড়িয়ে শ্বাসরোধ করে অর্ধশত মানুষকে হত্যার পরও আমাদের টনক কি নড়েছে? খোদ বেইলি রোডের যেসব বাণিজ্যিক ভবনে একাধিক রেস্তরাঁ চলছে তা কি বন্ধ করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ- না করা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন থাকে আর কতো প্রাণ বিপন্ন হবে এ ধরনের মৃত্যুকূপ চালাবার মাধ্যমে। আমাদের একাধিক প্রতিবেদক রাজধানীর বেশকিছু এলাকায় সরজমিন ঘুরে দেখেছে অনেক ভবনে রেস্তরাঁ আছে কিন্তু নামার সিঁড়ি পর্যন্ত নেই। কি বিস্ময়কর! ওধো আর বুধোর এই খেলায় অর্থাৎ একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর খেলায় অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেছে। পুরনো ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা, আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টস, বনানীতে বহুতল ভবন, সীতাকুণ্ডের কেমিক্যাল কারখানায় আগুন- সবশেষ বেইলি রোড। নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি। এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার পর এই শহরে অগ্নি ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় বড় নিরাপত্তা ব্যুহ এতদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়ার পরও পুরনো ঢাকার এখনো অসংখ্য বাড়িতে কেমিক্যাল মজুত রয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্ন থাকে রাষ্ট্রযন্ত্র কি এতটাই দুর্বল যে, শোনাউল্লা শুনে যা আর বকাউল্লা বকে যা- এই অবস্থা। না হলে একেকটি ঘটনার পর নির্দেশ দেয়া হয় কিন্তু ঐ পর্যন্তই। রাজউক বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের দায়িত্ব এই শহরে অনিয়ম চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কই, ব্যবস্থা নেয়া হলে তো বেইলি রোডে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। তারা নীরবে, চোখে কালোপট্টি বেঁধে নোটিশ নামক ফাঁদ তৈরি করে দায়সারা কাজ করবে। যখন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন বলবে আমরা আগেই বলেছি, এই ভবনের রেস্তরাঁ চালাবার অনুমতি ছিল না। আমরা নাগরিকরাও দু’চারদিন দুঃখ করবো, মিডিয়ায় লেখালেখি করবো, টকশোতে গরম গরম কথা বলবো, তারপর যেই লাউ সেই কদু।

 

____কাজল ঘোষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here