ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে এবার হাজির হয়েছে রমজান মাস। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে পিষ্ট মানুষ অস্বস্তি নিয়ে শুরু করবে সিয়াম সাধনা। নানা অজুহাতে সময়ে সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে এখন অনেক পণ্যই ক্রেতার নাগালের বাইরে। নতুন করে বেড়েছে রমজাননির্ভর পণ্যের দাম। ইফতার সামগ্রীর দামও এবার আকাশচুম্বি। পণ্যের বাড়তি দামের কারণে আগে থেকেই নাভিশ্বাস অবস্থা সাধারণ মানুষের। রমজানে এই ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। রোজার আগে বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছিল সরকার। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানা ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আদতে বাজারে এর তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
রোজার আগেই চিনি, ভোজ্য তেল ও খেজুরের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। রমজান শুরু হলেও এসব পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হলেও এখনো খুচরা বাজারে এ দামে তেল মিলছে না। চিনির দাম আগের অবস্থায়ই আছে। ব্যবসায়ীদের দাবি খেজুরকে বিলাস পণ্য ধরে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় এর দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ কারণে এবার ইফতারের অন্যতম অনুসঙ্গ খেজুর কিনতে ঘাম ঝরছে ক্রেতার। এবার কম দামে আর খেজুর কিনতে পারছেন না ক্রেতারা।
শুধু এসব পণ্যই নয় বাজারে একের পর এক দাম বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের। শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ফল কোনোটির দামেই স্বস্তি নেই। বিদেশি ফলে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করায় গত বছরের চেয়ে দাম বেড়েছে অনেক। নিত্যপণ্যের দামে কোণঠাসা হওয়া মানুষদের অনেকে এখন আর ফল কেনার সাহস পান না।
রমজানের আগে থেকে চড়তে শুরু করেছে ইফতার সামগ্রীর দাম। বিভিন্ন ধরনের শরবত, পানীয়, শসা, লেবু এমনকি বেগুনের দামেও উলম্ফন হয়েছে গত কয়েকদিনে।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ১৩ই জানুয়ারি টুঙ্গিপাড়ায় এক বৈঠকে নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের নির্দেশনা দিয়ে শেখ হাসিনা রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফেও নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। কিন্তু আদতে বাজারে পণ্য মূল্য কমানো যায়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেড়েছে। এর বাইরে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কিছু বক্তব্য সাধারণ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
গত ৪ঠা মার্চ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, আমাদের অভাব অভিযোগ আছে। বরই দিয়ে ইফতার করেন। আঙ্গুর, খেজুর লাগবে কেন? পেয়ারা দেন না কেন? দেশি ফল দিয়ে ইফতারের প্লেট সাজান।
নতুন দায়িত্ব নেয়ার পর ১২ই জানুয়ারি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছিলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। তাই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার এবং ব্যবসায়ীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। এ ব্যাপারে সবার সঙ্গে কথা বলে উদ্যোগ নেয়া হবে। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, সবার সঙ্গে কথা বলে অগ্রাধিকার ঠিক করা হবে।
৪ঠা মার্চ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে রমজান উপলক্ষে এবার কোনো পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
সংশ্লিষ্টরা এমন নানা আশ্বাস দিলেও বাজার পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। কমেনি ক্রেতাদের অস্বস্তিও। কাওরান বাজারে আসা রায়হান আহমেদ বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। সরকার দাম না কমালে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হবে।
বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন আসমা বেগম। কি কিনলেন প্রশ্ন করতেই তিনি এক কেজি শিম কিনেছেন উল্লেখ করে বলেন, এত দামে তো কিছু কেনা যায় না।
কাঁচাবাজারে ঘুরছিলেন আশিষ। তিনি বলেন, বাজারের সবকিছুর দাম অনেক বেশি। আমরা যারা মধ্যবিত্ত আছি, তাদের জন্য অনেক কষ্টকর হচ্ছে। লেবু কিনতে গেছি, লেবুর ডজন চাইছে ২২০ টাকা। রোজার জন্য নাকি বেড়ে গেছে।
দরদাম করে ১০০ টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ কিনলেন শামীমা। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। বলেন, কাল যে দাম দেখছি আজ তার থেকে বেশি। অন্য দেশে দেখি ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠানে দাম কমে, আর আমাদের দেশে উল্টো বাড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সঙ্গে তার বেতন বাড়েনি উল্লেখ করে বলেন, আমাদের বেতন বছরে হয়তো একবার বাড়ছে, কিন্তু বাজারে সবকিছুর দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। এভাবে চলা তো অনেক কষ্টকর।
খেজুরের বাজারে দরদাম করছিলেন আবদুর রহমান। একটি সরকারি মেডিকেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, সবকিছুই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। রমজানে খেজুর কেনা সাধ্যের বাইরে। তবুও বাধ্য হয়ে যতটুকু পারা যায় কিনতে হচ্ছে।
একটি বেসরকারি হাসপাতালে সহকারী ম্যানেজারের চাকরি করেন ইউসুফ আহমেদ লিটন। তিনি বলেন, যে তরমুজ গত বছরে ৪০ টাকা কেজি দরে খেয়েছি। ওই তরমুজ এখন ৯০ টাকা কেজি দাম চাইছে।
ফলের বাজারে এসেছিলেন নিলুফার ইয়াসমিন। দরদাম করে কমলা কিনছিলেন। ফলের দাম কেমন দেখছেন- জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, গত বছর কমলা ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা করে কিনেছি। সেইটা এখন ২১০ থেকে ২২০ টাকা কেজি।
রমজান শুরুর আগের দিন গতকাল বাজার ঘুরে দেখা গেছে সব ধরনের মুরগির দাম চড়া। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা, মানভেদে সোনালী জাতের মুরগি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি, দেশি মুরগি ৬৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
কাঁচাবাজারের সব পণ্যই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি হালি লেবু ৫০ থেকে ৬০ টাকা, প্রতি কেজি শসা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টমেটো ৫০ থেকে ৬০ টাকা, মানভেদে বেগুন ৫০ থেকে ১৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
আদার কেজি ২০০ টাকার ওপরে। প্রতি কেজি পিয়াজ ১০০ টাকা, মানভেদে রসুন ১৫০ থেকে ২১০ টাকা, আদা ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানিকৃত ফলের মধ্যে গালা আপেল ৩৬০ টাকা, রয়েল গালা আপেল ৩৮০ টাকা, সবুজ আপেল ৩২০ টাকা, চায়না ফুজি আপেল ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি মালটা ৩৫০ টাকা, সবুজ আঙ্গুর ৩৫০ টাকা, কালো আঙ্গুর ৪২০ টাকা, আকারভেদে কমলা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, আনার ৩৬০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে সব ধরনের খেজুর গত বছরের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি দাবাস খেজুর ৪৫০ টাকা, জাহেদি ৩০০ টাকা, মাশরুক ৮০০ টাকা, আলজেরিয়ান খেজুর ৫০০ টাকা, মাবরুম ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকা, মরিয়ম ১০০০ টাকা, মানভেদে আজুয়া খেজুর ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকা, আম্বার ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা, কালমি ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা, সাফাভি ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।