বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইনসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের চলমান সংঘাত কিছুটা কমেছে। দেশটির সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা এখন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। দুই পক্ষের গোলাগুলি ও মর্টারশেল নিক্ষেপে উত্তপ্ত ছিল বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকাও। এসব এলাকার মানুষ আতঙ্কে ঘরও ছেড়েছিলেন। তবে গত দু’দিন থেকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। তাতে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও ভয় কাটছে না বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তুমব্রু-ঘুমধুমের ওপারের তুমব্রু ও ঢেঁকিবুনিয়া ক্যাম্প দুটি আরাকান আর্মি দখলে নেয়ার পর সেখানে এখন গোলাগুলি বন্ধ রয়েছে। ভয় ও আতঙ্কে বান্দরবানের তমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত থেকে সরে যাওয়া প্রায় ২শ’ পরিবারের অধিকাংশই এখন ঘরে ফিরেছেন। যে আশ্রয়কেন্দ্রটি খোলা হয়েছিল সেখান থেকেও লোকজন চলে গেছে। কয়েকদিন বন্ধ থাকা তুমব্রু বাজারটিও খুলেছে। তবে সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘাতের কারণে সেখানে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে চাকমা, তঞ্চঙ্গা ও রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।
তাই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের সীমান্তে কড়া নজর রাখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও ভয় কাটছে না স্থানীয়দের। তারা মনে করছেন যেকোনো সময় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরেই গুলির শব্দে ঘুম ভাঙছে বলে জানিয়েছেন উলুবনিয়া সীমান্ত এলাকার এক বৃদ্ধা।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের সামনে বসেছিলাম তখন একটি গুলি এসে বাড়ির আঙিনায় পড়ে। সবাইকে নিয়ে ভয়ে দিন কাটছে। ঘর থেকে বের হতেই ভয় লাগে। স্থানীয় এক মাঝি জানান, তারা নাফ নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থায় তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। যাদের অন্য জায়গায় থাকার মতো পরিস্থিতি আছে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যারা দিন এনে দিন খায় তারা তো মৃত্যুকে সঙ্গী করেই এখানে থাকছেন।
তিনি বলেন, সামান্য জমিজমা আছে, সেগুলোও চাষ করতে পারছি না। সকালেও চাষের জন্য গিয়েছিলাম, কিন্তু গুলির শব্দে ভয়ে ফিরে এসেছি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ২৬ নং শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রধান নেতা বজলুর রহমান বলেন, আমরা আরাকান আর্মিদের পক্ষে আছি। তারা যৌক্তিক আন্দোলন করছে। তবে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায় আমরা তাদের নিরুৎসাহিত করছি এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজনদেরকেও জানাচ্ছি।
এদিকে বিজিবি’র ওয়াইক্যং কোম্পানি কমান্ডার আবু বলেন, চলমান অস্থিরতায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টায় আটকের পর দুই রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে হোয়াইক্যং বিজিবি। এ ছাড়াও বিজিবি’র মেজর শহিদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে গ্রেপ্তারকৃতদের ফেরত পাঠানোর জন্য তুমব্রু থেকে ১০০ জনকে টেকনাফের হ্নীলা সীমান্তে হ্নীলা হাই স্কুলে রাখা হয়েছে। তাদের নৌকাযোগে ফেরত পাঠানোর কাজ চলমান রয়েছে।
অন্যদিকে সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে ঘুমধুম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রটি সেখান থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা বিজিপি’র ১৩০ সদস্যকে। অন্যদিকে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে রয়েছে বিজেপি’র ৯৬ জন সদস্য। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসায় ঘরে ফেরা লোকজনদের প্রশাসন থেকে সার্বিক সহায়তা দেয়া হবে। ঘুমধুম একটি মাত্র এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র। পরিস্থিতি বুঝে দরকার হলে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রটি পরিবর্তন করার চিন্তা-ভাবনা করছি।
এদিকে গতকাল দুপুরে ঘুমধুম নয়াপাড়া নামক স্থানে অবিস্ফোরিত একটি মর্টারশেল উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন জানান, দুপুরের দিকে তার ওয়ার্ডের নয়াপাড়া এলাকার শিশুরা পরিত্যক্ত অবস্থায় মর্টারশেলটি দেখতে পেয়ে বিজিবিকে খবর দেয়। পরে বিজিবি পরিত্যক্ত মর্টারশেলটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তার ধারণা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীরা রাস্তায় মর্টারশেলটি ফেলে গেছে। ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. মাহাফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া জানান, পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি মর্টারশেল পাওয়া গেছে এবং মর্টারশেলটি বিজিবি উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ (বিজিপি) বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের সমুদ্রপথে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন। ওদিকে সীমান্তে চলমান উত্তেজনার কারণে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। আগামী ১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ করা যাবে না। তবে বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রাম কক্সবাজার নুনিয়াছড়া থেকে চালু রাখার পরিকল্পনার কথা ভাবছে জেলা প্রশাসন। অন্যদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে জাতিগত বিদ্রোহীদের চলমান সংঘর্ষে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মানুষের সংখ্যা ৩৩০ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য, সেনাসদস্য, পুলিশ সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন। বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, যারা অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হয়েছে।