দেখতে দেখতে একটি হিজরি সন ঘুরে আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। হিজরি সনের মাসের ক্রমানুসারে রমজান ষষ্ঠ মাস। সিয়াম সাধনার এ মাস মুমিনদের জন্য ফজিলতপূর্ণ একটি মাস।
এ মাসে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নেক কাজের এত বেশি প্রতিদান দেন যা অন্য কোনো মাসে দেন না। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য একমাস রোজা রাখা ফরজ করে দিয়েছেন।
রমজান মাসে রোজা রাখা ইসলামের প্রধান বুনিয়াদগুলোর একটি বুনিয়াদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল যেন তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।
এ মাসকে আল্লাহ তায়ালা কুরআন নাজিলের মাধ্যমে অন্য সব মাস থেকে অধিকতর সম্মানিত করেছেন। এ মাসের এমন একটি রাত রয়েছে যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি, সেই রাতটি হলো লাইলাতুল কদর।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি কদরের রাতে। আর আপনি কি জানেন কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহসমূহ নাজিল হয় তাদের রবের অনুমতিক্রমের প্রত্যেক দিক থেকে। সেখানে সূর্যোদয় পর্যন্ত শান্তি বর্ষিত হতে থাকে।’ (সুরা কদর : ১-৫)।
রমজান মাস হচ্ছে রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস আর প্রকৃত মুমিন বান্দাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও বহুল প্রতীক্ষিত মাস। পবিত্র রমজানে মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহর কালাম ও রাসূল সা:-এর হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
তাকওয়া অর্জনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত: মাহে রমজানে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জন্য কর্তব্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো’ (সূরা বাকারা-১৮৩)।
সিয়াম পালন: পূর্ববর্তী প্রত্যেক উম্মতের ওপরই আল্লাহ তায়ালা রোজা ফরজ করেছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় মুহাম্মদ সা:-এর উম্মতের ওপরও চারটি ধাপে পূর্ণভাবে রোজাকে ফরজ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’ আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। আকাশ যদি মেঘে ঢাকা থাকে তাহলে শাবানের গণনা ৩০ দিন পূরণ করবে’ (সহিহ বুখারি-১৯০৯)।
খুশুখুজুর সঙ্গে সালাত আদায় করা: মুমিনরা সফলতা পাবে খুশুখুজুর সঙ্গে সালাত আদায় করলে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন- ‘অর্থাৎ যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র।’ এখানে খুশুখুজু মানে অন্তরের এবং শরীরের একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা।
পাপাচার থেকে বেঁচে থাকা: শুধু দৈহিক চাহিদা পূরণ থেকে সংযমী হলেই সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয় না। সিয়ামের পূর্ণতার প্রধান উপাদান হচ্ছে পাপাচার থেকে বিরত থাকা।
এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘রোজা রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও অন্যায় আচরণ পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ এমন রোজা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। সুতরাং পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনার পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে হলে অন্যায় কার্যকলাপ থেকেও বিরত থাকতে হবে’ (তিরমিজি)।
তারাবি পড়া: রমজানে তারাবির সালাত আদায় করা সুন্নাত। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে রমজান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবির সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে’ (বুখারি-১৮৮২)।
কুরআন তিলাওয়াত করা: রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। কুরআন নাজিলের মাসে কুরআন বুঝার জন্য ব্যাখ্যাসহ অধ্যয়ন করার চেষ্টা করা।
সাহরি করা: রমজানে সাহরি খাওয়া হাদিসের ভাষায় বরকতপূর্ণ। আনাস রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।’
ইফতার করা ও করানো: রমজান মাসের বিশেষ আমল অন্যকে ইফতার করানো। কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন নবীজী সা.।
হজরত সালমান ফারসি রা. বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে পাবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।
বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার পড়া: রমজানে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা। কারণ রাসুল সা. এই আমলটি বেশি বেশি করতেন।
কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা করো। এতে আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপরাশিকে মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহর’ (তাহরিম-৮)।
তাহাজ্জুদ পড়া: রমজান মাস রহমতের শ্রেষ্ঠ মাস। রহমতের শ্রেষ্ঠ সময় তাহাজ্জুদের সময়। বছরের বিশেষ রাতসমূহে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার নিকটতম আসমানে অবতরণ করেন। তাহাজ্জুদের সময় প্রতিটি রাতেই আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের আরজি ও আবেদন-নিবেদন শোনেন।
দান সাদকাহ করা: রমজান মাসে যেহেতু সওয়াব ৭০ গুণ বেশি তাই এ মাসে বেশি বেশি দান সাদকাহ করা। প্রিয় নবী সা: উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন রমজান মাসে দান ও বদান্যতার হাত সম্প্রসারিত করতে। হাদিসেও রমজান মাসকে হামদর্দি বা ‘সহানুভূতির মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রমজানে রোজাদারগণ রোজা পালনের মাধ্যমে দানশীল ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২৭৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের প্রতিদান তাদের রবের নিকট রয়েছে। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’
বেশি বেশি দোয়া করা: রমজান মাস হচ্ছে দোয়া কবুল ও পুণ্য অর্জনের মাস। এ মাসে আল্লাহর অবারিত রহমত-বরকতের পাশাপাশি দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র করে নেয়া যায়।
এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমার কাছে দোয়া করো, আমিই তোমাদের দোয়া কবুল করব’ (সূরা মুমিন-৬০)। মাহে রমজানে দোজখের দরজাগুলো বন্ধ এবং বেহেশতের দরজাগুলো খোলা থাকে। শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে চারদিকে, যার ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবার হৃদয়-মন হয় বিগলিত ও ইবাদতপ্রবণ।
গোনাহ কম হয়, পুণ্যের কাজে অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। রমজান মাসে তারাবি, তাহাজ্জুদ, সাহরি ছাড়াও ইফতারে দোয়া কবুল হয়।
হাদিসে তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়ার কথা এসেছে, তার একটি হলো রোজাদারের ইফতারের আগ মুহূর্তের দোয়া। রমজানে মহানবী সা. আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি দোয়ার তাগিদ দিয়েছেন। দোয়ার মাধ্যমেই মহান রবের নৈকট্য হাসিল করা সহজ।
রমজান মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের মাস। সুতরাং এ মাসের শান-মান ঠিক রেখে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করা প্রত্যেক মুমিনের একান্ত দায়িত্ব।
লেখক: মো. লোকমান হেকিম , চিকিৎসক-কলামিস্ট