আজকেও রুনুর খাবার টেবিলে বসে ভাত খাওয়া নিয়ে অনিহা। রোজ-রোজ শাকপাতা দিয়ে ভাত খেতে তার ভাল লাগে না। দিন-দিন রুনুর ভাত খাওয়া নিয়ে বিদ্রোহী মনোভাবটা বেড়েই চলেছে। সে মাছ, মুরগী দিয়ে ভাত খেতে চায়। ওর মা ওকে প্রতিদিনই বলে, এইতো মা আজকে একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও, দেখি কালপড়শু তোমাকে মুরগী অথবা মাছ রেঁধে দিবো। কিন্তু রুনু বুঝে গেছে এইসবই মিথ্যা আশ্বাস। তাই মায়ের এইসব মন ভোলানো কথায় সে আর আশ্বস্ত হতে পারে না।
অনেক বোঝানোর পরেও মেয়ের এমন ভাত খাওয়া নিয়ে জেদ দেখে মা অগ্যতা মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসে। ওইটুকুন একটা মেয়ে চড় খেয়ে স্বাভাবিকভাবেই কান্না জুড়ে দেবার কথা। কিন্তু রোজ-রোজ এভাবে মায়ের হাতের চড় খেয়ে-খেয়ে রুনুর চোখ দুটি যেন অসাড় হয়ে গেছে। তাই চড় খেয়েও নীরব অভিমানে সে টেবিলে বসে থাকে। আজকাল সে নিজেকে জড় পদার্থের মতন ভাবতে শুরু করেছে। মেয়ের গালে চড় মেরে রুনুর মা দৌড়ে গিয়ে রান্না ঘরে বসে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে।
রুনু বুঝতে পারে মা ইচ্ছা করে তাকে চড় মারেনি। যে বয়সে বাচ্চারা নানা রকমের আবদার করতে শেখে, হাতের কাছে কাগজ পেলে তাতে ভূতের ছবি আঁকে, সেই বয়সে রুনু রান্না ঘরে মায়ের পেছনে-পেছনে ছুটে গিয়ে; মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে মায়ের কাছে জানতে চায়, তার বাবা কবে ফিরে আসবে?
ভয়াল অভিজ্ঞতার সেই রাতের স্মৃতি রুনুর শিশুমনে দাগ ফেলে দিয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন রাত বাজে দুইটা। রুনু তখন বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিলো। নিশ্চিন্ত মনের সেই ঘুম বহুদিন হয়ে গেলো রুনু আর সেই রাতের পর কখনোই ঘুমাতে পারে নাই। বাড়িতে হঠাৎ একগাদা লোকের সমাগম৷ দেখে আতংকে রুনুর ঘুম ভেঙে যায়। বাড়ির সবকিছু ওরা লণ্ডভণ্ড করে দেয় মুহূর্তের মধ্যে। এমনকি রুনুর খেলনার ঝুড়িটাও রেহাই পায়নি। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি তালাশি করে। অথচ তারপরেও রুনুর চোখের সামনেই ওর বাবাকে লোকগুলো ধরে নিয়ে যায়।
তারপর বাবার সাথে রুনুর শেষ দেখা হয় আদালতের বারান্দায়। কাঠগড়া থেকে নামিয়ে হাত বেঁধে ওর বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। যাবার সময় মেয়েটার গালে চুমু খেয়ে যায় ওর বাবা। রুনু জানে ওর বাবা কোনো দোষ করেনি। মা বলেছে, ওর বাবা যেদিন ফিরে আসবে সেদিন ইচ্ছে মতন মাছ আর মুরগী দিয়ে ভাত খেতে পারবে। রুনুর বাবা দেশীয় মুরগী খেতে বলেছে, আর ফার্মের মুরগী খেতে বারণ করেছে। বলেছে, ওতে কোনো পুষ্টিগুণ নেই। অবুঝ রুনু তাতেই মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়।
লেখকঃ আরজান ইভান, গবেষক ।