আমাদের সমাজে কোনো একটা দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা বা কারও জন্মকে দায়ী করা খুবই সহজ ব্যাপার। কারও জন্মের সময় যদি তার মা মারা যায় তখন তার জন্য দায়ী করা সেই মেয়েকেই। অনেকে বলে থাকে, এই মেয়ে তার মাকে খেয়েছে। এই ধরনের হীন মানসিকতার মানুষ আমাদের সমাজে অহরহ বাস করছে। আবার অনেক সময় কোনো পুরুষ যদি স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আগের ঘরের সন্তানের ওপর বিরূপ আচরণ করে। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কারণ নারীরা মায়ের অনুভূতিকে খুবই সম্মান করে তাই হয়তো অনেকেই নিজের সন্তানের মতো করেই মেনে নেয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কবি আরও বলেছেন, ‘কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী, পুরুষের তরবারি; প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ী লক্ষ্মী নারী।’
মূলত প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সমাজ দেশ জাতির উন্নতির কল্পে নারী-পুরুষের অবদান পার্থক্য করার মতো নয়। আমরা অনেকেই হয়তো ঠাট্টা বিদ্রুপ করে বলি যে, নারীরা জন্মেছে শুধু হেঁসেল সামলানোর জন্য। কিন্তু কখনো ভাবি না যে ওই হেঁসেল সামলানোও বড্ড কঠিন কাজ। আমরা তো একদিনের বেশি দুইদিন রান্নাঘরের উত্তপ্ত গরমে যেতে চাইবো না।
কিন্তু মায়েদের শীত গরম বৃষ্টি বাদলা বলে কোনো কথা নেই, তারা চিরকাল হেঁসেল সামলে যাচ্ছেন। এমনকি অনেক মায়েরা তো বাহিরে চাকরি বা অন্যান্য কাজ করে এসেও হেঁসেল সামলাচ্ছেন।
কথায় কথায় একটা কথা উঠে এসেছে, সেটা হচ্ছে মা! মা এক অক্ষরের একটা শব্দ, কিন্তু সম্ভবত এই শব্দটার চেয়ে জোরালো কোনো শব্দ পৃথিবীতে নেই। আমাদের প্রিয় নবী (স.) মায়ের গুরুত্ব বুঝাতে তিনবার মায়ের কথা বলেছেন, চতুর্থবার তিনি বাবার কথা বলেছেন।
নারীরা মায়ের জাত। নারী কেউ আমার মা, কেউ ভগ্নি আর কেউ হয় পত্নী। কিন্তু নারীকে সহজ চক্ষু দিয়ে দেখা আমাদের জন্য কঠিন। নারীদের ছাড় দেয়ার মানসিকতা আমাদের মাঝে একদম নেই বললেই চলে। আমাদের সমাজে নারীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রথায় নির্যাতন করা হতো। কখনো কোনো রাজার আমলে নারীরা হয়েছে ভোগের পণ্য। এমন অনেক রাজা ছিলেন, তাদের যেদিন যাকে পছন্দ হতো সেদিন তাকে রাজমহলে তুলে আনতো। যুগে যুগে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমরা সতীদাহ প্রথাও দেখেছি, দেখেছি নারী কর্তৃৃক স্বামীকে দেবতা বানিয়ে রাখার প্রথা।
একটা মেয়ে যখন জন্ম নেয় তখনই তার জীবনের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার যুদ্ধ হচ্ছে পুরো সমাজব্যবস্থার সঙ্গে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার মাকে কথা শুনতে হয় কন্যা শিশু জন্ম দেয়ার জন্য। নিজের পরিবার এমনকি তার স্বামীও মাঝেমাঝে কথা শোনায় তাকে। সমাজে মেয়েরা বেড়ে ওঠে নানান ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে। শিশু অবস্থায়ই অনেক মেয়েকে হতে হয় যৌন নির্যাতনের শিকার। নিজের আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী দ্বারাই বেশি আক্রান্ত হয় মেয়ে শিশুরা। শিশুদের পাচার করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেয়ার কুপ্রথা রয়েছে আমাদের সমাজে। পাচার শিশু ও পূর্ণবয়স্ক সবারই হয় তবে এক্ষেত্রেও এগিয়ে নারী পাচারের হার।
গ্রামগঞ্জের মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। এখনো দেশে বহু জায়গায় বাল্যবিবাহের প্রথা রয়েছে। মেয়েরা শুধু শুধুই ঘরের অন্ন ধ্বংস করে বলে মনে করে গ্রামীণ সমাজ। মেয়েদের পড়ালেখা শেখানো পাপের কাজ মনে করে তারা। পড়ালেখা শিখলে মেয়েরা অবাধ্য হয়ে যাবে এমন ধারণা এখনো বিদ্যমান। গ্রামীণ ধনবানরা নিজেদের কুসন্তান কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তানকে বিয়ে দেয়ার জন্য খুঁজে বের করে গরিব ঘরের কোনো সুন্দরী মেয়েকে। অনেক ক্ষেত্রেই চাপিয়ে দেয়া হয় তাদের ওপরে।
আমাদের সমাজে কোনো একটা দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা বা কারও জন্মকে দায়ী করা খুবই সহজ ব্যাপার। কারও জন্মের সময় যদি তার মা মারা যায় তখন তার জন্য দায়ী করা সেই মেয়েকেই। অনেকে বলে থাকে, এই মেয়ে তার মাকে খেয়েছে। এই ধরনের হীন মানসিকতার মানুষ আমাদের সমাজে অহরহ বাস করছে। আবার অনেক সময় কোনো পুরুষ যদি স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আগের ঘরের সন্তানের ওপর বিরূপ আচরণ করে। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কারণ নারীরা মায়ের অনুভূতিকে খুবই সম্মান করে তাই হয়তো অনেকেই নিজের সন্তানের মতো করেই মেনে নেয়।
এসিড নিক্ষেপ বেশকিছু বছর আগে অনেক ভয়াবহ একটি রোগ ছিল। কোনো মেয়েকে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আশাহত হলেই তার ওপর ঈর্ষা করে এসিড নিক্ষেপ করা হয়। এই সমস্যা একদম মহামারি আকার ধারণ করেছিল। বহু মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে এই এসিড নিক্ষেপের ভয়াল আঘাতে। তবে যথাযথ শাস্তি তথা চূড়ান্ত শাস্তি ফাঁসি ধার্য করার ফলে এসিড নিক্ষেপের মতো গর্হিত কাজ থেকে সরে আসে অপরাধীরা। তবে অপরাধ কমে গেলেও শেষ তো আর হয়নি। শকুনেরা এখনো ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে হানা দেয়।
মেয়েদের প্রতি অশালীন আলোচনা থেকে দূরে থাকতে পারে না শিক্ষকরাও। হোম টিউটর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষকেরাও মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ করে। অনেক সময় মেয়েরা ভয়ে কিছু বলতে পারে না। অনেক সময় আবার মেয়েদের ফাঁদে ফেলে দীর্ঘদিন নির্যাতন চালায় তারা। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ভালো নম্বর দেবার প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দেয় শিক্ষকেরা। অনেক সময় শিক্ষকেরা আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিতেও চায়।
কিছু মানুষ এই সমাজে পাওয়া যায় যারা মেয়েদের সামান্য একটু সাহায্য করেই তার প্রতিদান নিতে চায়। এই প্রতিদান হিসেবে তারা নিতে চায় মেয়েদের সম্ভ্রম। বেশির ভাগের নজর ঘুরে ফিরে ওই শরীর ঘিরে। মেয়েদেরকে অন্য চোখে দেখা মানুষদের আলাদা একটা প্রজাতিই আছে। তারা সবসময় ঘুরে বেড়ায় কাউকে একটু সাহায্য করার। সাহায্য করে কাছে যেতে পারলেই হয়ে গেল। কাছে গিয়ে চেষ্টা থাকে তার সংস্পর্শে যাওয়ার।
গণপরিবহন মেয়েদের জন্য বিশাল একটা সমস্যার জায়গা। এতে উঠতে গেলেই হেলপারের কুস্পর্শের শিকার হতে হয়। বাস থেকে কেউ নামতে গেলে বা কেউ বাসে উঠতে গেলে কোনো মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজে স্পর্শ করে। কোনো মেয়ে সিটে বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে তার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায় মানুষ। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা যায় কোনো মেয়ে যদি গাড়িতে একা থাকে তখন। নির্জন জায়গায় একা থাকলে তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয় এমন ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। গণপরিবহন ভয়ানক একটি জায়গা। রাস্তায় একা একটা মেয়ে দেখলে অনেকে তাকে সুযোগ মনে করে। কিন্তু উচিত তো তাকে আমাদের দায়িত্ব মনে করা। গভীর রাতে কোনো মেয়েকে দেখলেই আমরা ভাবি যে, হয়তো খারাপ কাজ করতে বের হয়েছে। তাই তাকে ভিন্ন ধরনের ইঙ্গিত করা হয়। কিন্তু উচিত তো মেয়েটা কোনো বিপদে পড়েছে কিনা সেটা জেনে তাকে সাহায্য করা। সেটা না করে তার ওপর হামলে পড়ে বা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করা হীনমন্যতার পরিচয়। এই পরিচয় দেখানো মানুষের সমাজে অভাব নেই।
সম্প্রতি একটা বিষয় খুব ভাইরাল হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন হয়রানি। এখানে একটা বাস্তব গল্প বলতেই হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন একজন গুণধর শিক্ষক আছেন। তিনি ছাত্রীদের খুব আদর করতেন, তিনি আদর করার জন্য পিঠে হাত দিয়ে লেপে দিতেন।
একদিন খুব সকালে আমার সংগঠনের এক জুনিয়র আমাকে ফোন দিয়ে বললো, সেই শিক্ষক ফোন দিয়ে বলেছে, তুমি তো খাতায় আটাত্তর পেয়েছ, আর দুই নম্বর কোথায় দেয়া যায়, তুমি একটু এসে দেখাই দিয়ে যাও!
আমি বললাম, লাগবে না যাওয়া।