মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি কম টিকে থাকাই কঠিন

0
97

ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন আতাউর রহমান। সেখান থেকে প্রতি মাসে তিনি বেতন পান ২০ হাজার টাকা। এই অর্থ তার পরিবারের খরচ মেটাতে যথেষ্ট নয়। এজন্য অফিস শেষে ইলেকট্রিকের কাজ করেন তিনি। এরপরও আতাউরের পক্ষে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সঙ্গে অন্যান্য খরচও বেড়েছে। নতুন বছরের শুরুতে বাড়িভাড়াও বেড়েছে। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য বেশি খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু ইনকাম সেভাবে বাড়েনি।

প্রতি মাসে যে বেতন পাই তা দিয়ে পরিবার চালানো কঠিন। এজন্য অফিস শেষে ও ছুটির দিনে ইলেকট্রিকের কাজ করি। তবুও পেরে উঠছি না।

আরিফুল ইসলাম ৭ বছর ধরে ঢাকায় প্রাইভেট কার চালান। বেতন পান ১৮ হাজার টাকা। স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে দুই বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করতেন। নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। সন্তানকে ঢাকায় পড়ানোর সামর্থ্য না থাকায় বছরের শুরুতেই স্ত্রী ও সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আগারগাঁওয়ের একটি চায়ের দোকানে বসে এসব কথা জানান আরিফুল। বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ি চালাচ্ছি। বেতন দিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক কাটছাঁট করে চলতে হয়। এই বছর আবার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। এজন্য গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। বেতনের অধিকাংশ টাকাই বাড়িভাড়ায় চলে যায়। বর্তমানে আমি একটি রুম সাবলেট নিয়ে বসবাস করছি। তিনি বলেন, সকল পণ্যের দাম বেড়েছে। বছরের শুরুতেই বাড়িভাড়া বেড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দামও অনেক বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়েনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। মাসটিতে মজুরিসূচক বেড়ে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কোনো পণ্য কিনতে যেখানে খরচ হতো ১০০ টাকা, সেখানে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সেটি কিনতে লেগেছে ১০৯ টাকা ৪১ পয়সা। অথচ মজুরি বেড়েছে ৭ টাকার সামান্য বেশি। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার কেনাকাটায় দেড় টাকা ব্যয়ের জোগানের ব্যবস্থা নেই একজন শ্রমিকের। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। গবেষকরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন  বলেন, মানুষের ইনকাম না বাড়লেও খরচের পাল্লা দিন দিন বাড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, বাড়িভাড়া বেড়েছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সরকার এর আগে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে থেকে তারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করেছে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সরকার আগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করলে প্রস্তুতি নিতে পারতো। তাহলে মানুষের জন্য ভালো হতো। এখন তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও আসলে তাদের প্রস্তুতি নেই। হঠাৎ করে তো আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন না। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে কিছুটা মাঠে দেখা গেলেও অন্য কোনো সংস্থাকে মাঠে দেখা যায় না। তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। তিনি বলেন, মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। ঘরভাড়া বেশি হওয়ায় অনেকে গ্রামে চলে গেছে। অনেকে সাবলেট থাকছে। অনেকে গ্রামে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার এখন বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছে। তবে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই দেখার বিষয়।

বাজার পরিস্থিতি: বাজারে গিয়ে ভোক্তার স্বস্তি মিলছে না। চালের দাম বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও ঢাকার বাজারে চালের দামে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। উল্টো বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম। বাজার ঘুরে দেখা যায়, নভেম্বরে প্রতি কেজি চিনি ১৩৫ টাকা বিক্রি হলেও ডিসেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৪৫-১৫০ টাকা। চলতি বছর জানুয়ারিতেও একই দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি ভালোমানের মসুর ডাল নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা। ডিসেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকা, আর জানুয়ারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। প্রতি কেজি ছোলা নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। ডিসেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা। জানুয়ারিতে বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকা। ভোজ্য তেলের মধ্যে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা। ডিসেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৫৫ টাকা, আর জানুয়ারিতে দাম বেড়ে ১৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের মধ্যে নভেম্বরে প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৬৮ টাকা, ডিসেম্বর ১৭০ টাকা ও জানুয়ারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৭৩ টাকা। আটা ও ময়দার দামও ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এদিকে গত বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ৫৯৫ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে। ফলে ভোক্তা অধিদপ্তর থেকেও মাংসের দাম সহনীয় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে নিম্নআয়ের মানুষ মাংস কিনতে পারেন। কিন্তু ফের কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে গরুর মাংস। বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা। প্রতি কেজি লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। শীতের সবজির ভরা মৌসুমে অধিকাংশ সবজির দাম বেড়েছে। মাছের দামও নাগালের বাইরে রয়েছে। পাশাপাশি ফার্মের মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here