‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমার বাবা আসে না। বাবা গুম হয়েছে। আমার কষ্ট হয়’। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল শাহীনবাগের নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের মেয়ে আরোয়া ইসলাম। ‘গুম-খুন, ক্রসফায়ার, কারা নির্যাতন বন্ধ করো! মানবাধিকার লঙ্ঘন রুখে দাঁড়াও!’- শীর্ষক এ মানববন্ধনের আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’। মায়ের ডাক এর সভাপতি হাজেরা খাতুন এর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখনে- সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। উপস্থিত ছিলেন, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরাও। সমাবেশ থেকে বিএনপি’র বন্দি নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে সংগঠনটি।
পুলিশের বাধা পেয়ে সেখান থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে যান সংগঠনের সদস্যরা। বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন শুরু হয়।
পুলিশ মাইক কেড়ে নিয়েছে অভিযোগ করে মায়ের ডাকের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের ৪৪টি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমরা মানববন্ধনের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের মাইক কেড়ে নেয়া হয়েছে। এদেশে আমাদের দুঃখের কথা বলার অধিকার পর্যন্ত নেই। পুলিশ স্বজনহারা পরিবারগুলোকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষকে গুম করা হচ্ছে। খুন করা হচ্ছে। সরকারের সাহস নেই এই সত্য মোকাবিলা করার। স্বজনদের খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের আওয়াজ বন্ধ করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছরে ৫ শতাধিক মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী, কমিশনার চৌধুরী আলমসহ অনেকেই রয়েছেন এই তালিকায়। আপনাদের কত বুলেট আছে, কত গুলি আছে আমরা তা দেখতে চাই। আজ তিন হাজার ৬৫৩ দিন আমার ভাইয়েরা নিখোঁজ। যতদিন আমাদের ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ফেরত না পাবো ততদিন আমরা আওয়াজ তুলবো। আমরা আমাদের সব ভাইকে ফেরত আনবো। মানববন্ধনে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নী বলেন, দশ বছর আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই। আমরা রাস্তায় রাস্তায় ভাইয়ের জন্য কাঁদি। আমরা আমাদের কথা বলতে শাহবাগে দাঁড়িয়েছিলাম। কেন টেনেহিঁচড়ে আমাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন? আমরা কি এই দেশের নাগরিক না?
বিএনপি নেতা কাওসারের শিশুকন্যা লামিয়া আক্তার মিম বলে, আজ ১১ বছর আমি আমার বাবাকে দেখি না। বাবাকে ফেরত চাই। তার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে চাই। আমি বলতে বলতে ক্লান্ত। আমি আমার পাপাকে ফেরত চাই। আমার পাপাকে ফেরত দিন। বংশাল থানা ছাত্রদলের সভাপতি পারভেজের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, আজ ১০ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার বাচ্চাকে কেন শাহবাগে গাড়ি থেকে নামতে দেয়া হয়নি। আরেক স্বজন বলেন, আমার ভাইয়ের খবর দিন। আমার ভাইকে ফেরত চাই। বিএনপি নেতা সোহেলের মেয়ে সাফা বলে, ১০ বছর ধরে আমি আমার বাবাকে দেখিনি। বাবা বলে ডাকতে পারি না। সরকারের কাছে একটিই আবেদন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। বিএনপি নেতা সুমনের ভাতিজি সাবিহা বলে, আমি আমার সুমন চাচ্চুকে ফেরত চাই। তার সঙ্গে টেবিলে একসঙ্গে বসে খেতে চাই। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে ‘গুম ফেরত’ হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, আমাকেও দীর্ঘদিন গুম করে রাখা হয়েছিল। এখনও সরকার মিথ্যাচার করছে। আমরা আর এই সরকারের কাছে অনুরোধ করবো না। এই সরকারের পতনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাইদের ফিরিয়ে আনবো। যতদিন আমরা ন্যায় বিচার না পাবো ততদিন আমরা রাজপথে থাকবো। গুমের শিকার মো. পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারহানা আক্তার বলেন, আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে হবে না। আপনার কাছে রেখে দেন। শুধু বলেন- কেন গুম করেছেন? স্বামী হারা মানুষের কষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের কেউ বুঝবে না।
মানববন্ধনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ফ্যাসিস্ট দানবীয় সরকার মানুষের লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এই স্বজনহারা মা-বোনদের কথা, তাদের বুকের বেদনার কথা সরকার চিন্তা করছে না। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এখন মানুষের সমস্ত মানবিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, মৌলিক অধিকার ও ভোটের অধিকার হরণ করে তারা (সরকার) একটি তামাশা তৈরির চেষ্টা করছে। পুলিশসহ এই সরকারের যত বাহিনী আছে, যত অত্যাচারই করুক, মায়ের ডাক তারপরও তাদের লড়াই অব্যাহত রাখছে।
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন- গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও ডা. ফয়জুল হাকিম প্রমুখ। এদিকে মানববন্ধনে বাধা দেয়ার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. আক্তারুল ইসলাম বলেন, মানববন্ধনের জন্য তারা কোনো অনুমতি নেয়নি। তাই শাহবাগে তাদের মানববন্ধন করতে নিষেধ করা হয়। তখন তারা আমাদের বলেন, তাহলে আমরা প্রেস ক্লাবে প্রোগ্রাম করবো। এরপর তারা প্রেস ক্লাবে চলে যান।