একরাম আলি
বেশ কয়েক বছর ধরে অগ্রবর্তী তরুণ পাঠকমহলে কানাঘুষো এ-রকম একটা কথা ছড়াচ্ছে যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নবীনতা হারিয়েছে। সে কি প্রৌঢ়ত্বের পর্যায়ে, নাকি একেবারে বার্ধক্যেই পৌঁছে হলুদ আকাশ-কিনারার কোনাকুনি আরামচেয়ার পেতে বসেছে এখন? নাকি মৃতই?
কানাঘুষো থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ-সব প্রশ্নের ফয়সালা এখনও হয়ে ওঠেনি। তবে, অনতিদূর ভবিষ্যতের উত্তর তেমন আশাপ্রদ হবে না – এও বোঝা যাচ্ছে।
এখনকার এই তরুণেরা নাতিতরুণ বয়সে সাগ্রহে মানিক পড়েছেন। তাঁদের সেই পাঠ ছিল ম্যালোরির এভারেস্ট-যাত্রার মতোই। শৃঙ্গ ছুঁতে পেরেছিলেন কি না স্পষ্ট জানা যায় না, তবে আশপাশের ওই বরফক্ষেত্রে নিজের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে আজ তাঁরা নিজেরাই বিস্মিত।
কেন এমন হল? কেন এই বিস্ময়? মানিক পাঠে কেন হালফিলের এই অনীহা? এগুলির এবং এদের সূত্র ধরে আরও অনেক প্রশ্নই আসবে, যে-সব প্রশ্নের মৌল রূপটি হল : বাংলাভাষার বিস্ময়কর লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার প্রাসঙ্গিকতা কি আজ হারিয়েছে? এই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি-প্রশ্নও আছে একটিই। সেটি হল : নাকি মানিক বান্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তার প্রত্নবস্তুর অনুসন্ধানে প্রয়োজন আজ নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতির? যুদ্ধোত্তর বিশ্বের পন্ডিতেরা বলছেন – পরিবর্তনশীল জগতের চলন-ইতিহাসে কোনো ধারাবাহিক যুক্তির স্রোত নেই। নেই দ্বান্দ্বিক ক্রমোন্নয়ন। আছে একধরনের সভ্যতার ও চিন্তাশৈলীর শেষে আরেক ধরনের টুকরো-টুকরো চিন্তাশৈলী, যাকে বলা হচ্ছে জ্ঞানাংশ(এপিস্টেমে)। জ্ঞানাংশ কী? কোনও বিশেষ যুগে যে-সব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যসব শক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক আমাদের বক্তব্যের শৈলী বা তার গঠনের রীতিকে নির্মাণ করে আর সর্বজনীন করে এবং শাস্ত্র আলোচনায় ব্যবহৃত হয়, তাদেরই বলা হচ্ছে জ্ঞানাংশ। একটা সময়ের শেষে এইসব জ্ঞানাংশ সরে যাচ্ছে আর খালি জায়গাগুলি ভরাট হচ্ছে নতুন জ্ঞানাংশ এসে। এবং এরই সঙ্গে শব্দেরাও বস্তু থেকে সরে গিয়ে তাদের অর্থ বদলে ফেলছে।
এইভাবেই ‘বদলে যায়, বদলে যায়, বদলে যেতে যেতে’ আমাদের প্রাগুক্ত তরুণ পাঠকের চিন্তার প্রত্নতত্ত্ব কি দিগন্তবিস্তৃত ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ অথবা ‘পদ্মানদীর মাঝি’র সৃষ্টিতরঙ্গে আজ আর কেঁপে উঠছে না? নাকি নতুন কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতির অনুশীলনে আজ আবার নতুন করে পড়তে হবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে?
অধুনাবিলুপ্ত ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশ ‘বেঙ্গলি নভেল টুডে’ নামের একটি নিবন্ধে লেখেন, “মানিক’স পদ্মানদীর মাঝি, হাওয়েভার, ইজ এ মোর ওয়েটি নভেল (পুতুলনাচের ইতিকথা-র তুলনায়)। বাট ইট মাস্ট নট বি অ্যালাইন্ড উইথ দ্য গ্রেটনেস অফ নভেলস সাচ অ্যাজ ওয়ার অ্যান্ড পিস, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ইউলিসিস, জোসেফ অ্যান্ড হিস ব্রাদার্স অ্যান্ড দ্য লাইক”’। (উদ্ধৃতির মধ্যে বন্ধনী-অংশটুকু আমার)।
এ-প্রসঙ্গে আবার পূর্বকথায় ফিরে যাই। জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত আর প্রকাশিত অথচ অধুনাবিলুপ্ত রচনাগুলির পুনঃপ্রকাশ এখন এই-যে সম্ভব হচ্ছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, সে-সবেরই প্রভাব কি পড়ছে তরুণদের ওপর? তরুণদের প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতি কি পালটে যাচ্ছে তার ফলে? হয়তো। হয়তো নয়।
তবু, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে, চারদিকে ছড়ানো এই-যে জীবনানন্দ রচনারাশি– এইসবের থেকে দূরে গিয়ে বা জীবনানন্দ-নিরপেক্ষ হয়ে থেকে এখন আর কোনো আলোচনা সম্ভব নয়। সম্পূর্ণও নয়। হয়তো পরে আবার হবে। এ-মুহূর্তে বাঙালি তরুণ পাঠকের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের, যাঁরা টিভি আসার পর স্বচক্ষে বিশ্ব-ফুটবল দেখে গড়ের মাঠের এতদিনকার খেলাধুলোকে ছেলেখেলা মনে করেছেন। বলা বাহুল্য, জীবনানন্দ দাশের এইসব রচনাই ওই টিভি-তে বিশ্বদর্শন। কেননা, সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য বিষয়ে এমন স্পষ্ট ভাষায় এমন নির্মোহ আলোচনা এই তরুণেরা আগে পড়েছেন বলে মনে করতে পারেন না। বিশ্ব-সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণা ছিল, তবু অবচেতন মনে কিছু নম্বর ‘গ্রেস’ হিসেবে রেখে তাঁরা পড়েছেন মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর। জীবনানন্দের রচনা এই ‘গ্রেস’-প্রথায় প্রথম আঘাত করল। যে, না, কোনও ‘গ্রেস’ দেওয়ার দরকার নেই। লেখাগুলিকে স্বভূমিতে দাঁড়াতে দাও। ভাঙলে ভাঙুক। ধসে পড়লে পড়ুক তারা। তারপর ঢুকে পড়ো এইসব লেখার প্রত্নবস্তুর অনুসন্ধানে।
জীবনানন্দের এই রচনাগুলিকে, আমার বিশ্বাস, এইভাবে দেখতে হবে। যে, কোনো পূর্বস্মৃতি আরোপ করে, কোনো বদ্ধমূল সংস্কার থেকে বা পূর্বকথিত প্যাটার্নে ফেলে সাহিত্যপাঠ আর চলবে না। তা, সে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ই হোক অথবা ‘গোরা’, ‘কবি’ই হোক বা ‘অনুবর্তন’।
যেমন ‘পদ্মানদীর মাঝি’র শুরুতেই, তৃতীয় অনুচ্ছেদের শেষে, মানিক লিখেছেন–‘ গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনদিন দ্যাখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে’। ঐতিহাসিকভাবে এই বাক্যটির সত্যতা আজ আর নেই। কেননা ‘গতিশীল জলতল’-এর ধারাবাহিকতা আজ বিনষ্ট হয়েছে। বিশাল- বিশাল চরে পদ্মা আজ কলঙ্কিত। তবু বাক্যটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়নি আজও। তার অর্থ পালটেছে মাত্র।
হোসেন মিঞাও তেমনই, কোনও প্রোটোটাইপের অংশমাত্রই সে হয়তো নয়, যে নাকি নয়া উপনিবেশবাদের স্বপ্ন দেখে। কুবির নয় শুধুমাত্র সর্বহারার প্রোটোটাইপের অংশ বা শীতলবাবু ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের। বীজগণিতের মতো ‘এক্স’ ধরে উত্তরের জন্য এগিয়ে যাওয়া সাহিত্যের কাজ নয়। তা হলে হয়তো ময়নাদ্বীপের দিকে কোনো দিনই যাওয়া সম্ভব হবে না আমাদের, যেখানে পড়ে আছে বিস্তীর্ণ অনাবাদী মাটি আর অচেনা বাতাস।
চিন্তার এই সঙ্কটের মুহূর্তে, আমার বিশ্বাস, পাঠকের দিকে আগের বলা প্রতিধ্বনি-প্রশ্নটিই আবার ফিরে আসবে এবং নিজের উত্তর সঙ্গে নিয়েই যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তার অনুসন্ধানে আজ কি তা হলে নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োজন? উত্তর, হ্যাঁ। হয়তো।
২
উত্তরসহ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখন আমরা বিপুলায়তন মানিক-সাহিত্যের একটুখানি খোলস ছাড়াবার চেষ্টা করব। তার আগে দেখব এই লেখকের মনোগঠনের পটভূমিটি ঠিক কেমন ছিল।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম সাঁওতাল পরগনার দুমকায়। পৈত্রিক বাড়ি পুববাংলার বিক্রমপুরের মালপদিয়া গ্রামে। ম্যাট্রিক পাস করেছেন মেদিনীপুর থেকে আর আই এসসি পাস করেছেন বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ থেকে। তারপর এসেছেন কলকাতায়, প্রেসিডেন্সিতে পড়তে। দুই বাংলার আর বিহারের নানা জায়গায় তাঁর পিতার বদলির চাকরি-সূত্রে তিনিও ঘুরতে ঘুরতে কাটিয়েছেন তাঁর বাল্য ও কৈশোরকাল, এমনকি প্রথম যৌবনও। তারপর শুরু হয় তাঁর কলকাতা-বাস। আর শুরু হয় তাঁর সাহিত্যজীবন। মাত্র ৪৮ বছরের স্বল্প-আয়ুর জীবনে কমবেশি ২৮ বছরের সাহিত্যচর্চার শুরুর রচনাটি ‘দিবারাত্রির কাব্য’। উপন্যাসটির ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন – ‘একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের projection- মানুষের এক-একটুকরা মানসিক অংশ’।
কিন্তু ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নয়। হাতে তুলে নিয়েছি অন্য একটা বই। দেখা যাক, বহু আলোচিত সেই বইটি এই সময়ে পৌঁছে কী এবং কতটা আমাদের দেয়। বা, আমাদের গ্রহণ-ভঙ্গি এখন কেমন।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ আবার পড়া হল। এ যেন বহুবার দেখে আসা কোনও বিখ্যাত জায়গায় অনেক বছর পর পুনর্ভ্রমণ। শশী ডাক্তার – একটি তুলনামুলক আলোচনায় যার প্রসঙ্গে এসেছিল আলবেয়ার কাম্যুর ‘দি প্লেগ’ উপন্যাসের ডাক্তার রিওর নামও—সেই শশী ডাক্তারের সঙ্গে আবার কাটানো গেল কয়েক ঘন্টা। আর কুসুম, আর মতি, গোপাল আর যামিনী কবিরাজ, যাদব পণ্ডিত আর তাঁর স্ত্রী, সেনদিদি আর কুমুদ আর বিন্দু, কলকাতাবাসী ভগ্নীপতি নন্দ – এদের সঙ্গেও।
এদের মধ্যে শশীকে বাদ দিলে লেখকের সবচেয়ে বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে যে চরিত্রটি, তার নাম কুসুম। সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগও এই কুসুমের প্রতিই বর্ষিত হয়েছে। নিঃসঙ্গ নবকুমারকে দেখে নিরাভরণ সাগর-সুন্দরী কপালকুণ্ডলার সেই উক্তি- ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ পড়ে যেমন বাঙালির মস্তিষ্কে একদিন সমুদ্রের নিশ্বাসের স্পর্শ লেগেছিল, জ্যোৎস্না রাতে ঘরের চালার ছায়ায় দাঁড়িয়ে কুসুমের প্রতি শশীর ‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?’ উক্তিটির ঘন্টাও একদিন বাঙালি পাঠকের নির্জন মন্দিরে ঢং ঢং করে বেজেছে।
তখন বাংলার গ্রাম-সমাজ ভাঙছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের রূপ বদলের সেই সময়ে একটা শিক্ষিত শ্রেণী বেরিয়ে আসছে সমাজ থেকে, আর ঢুকে পড়ছে নিজের নিজের কেন্দ্রে, যেখানে সে একাই সবকিছু। বা, তার পরিবারই সবকিছু। কারও ভালয় অথবা মন্দে যার অংশ থাকবে না। আস্তে আস্তে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে মনের সম্রাটত্ব কায়েম হচ্ছে। অর্থাৎ মন মরে যাচ্ছে। শশীর এ উক্তি যেন অবশিষ্ট অশিক্ষিত গ্রাম্য জীবনের দিকে ছুটে যেতে চেয়েছিল সেদিন। অথচ, এই উপন্যাসেই পালটা প্রশ্নের রূপে তার চমৎকার উত্তরও আছে। দিয়েছে কুসুমই। যাদব পণ্ডিতের মৃত্যুদিন ঘনিয়ে আসছে। সবাই চিন্তিত আর ব্যস্ত সেই মৃত্যু-অনুষ্ঠান নিয়ে। সে সময় শশীর কাছে এক ফাঁকে কুসুম এসেছে তার ‘শরীর’ নিয়ে। শশীকে দেখে কুসুম ‘উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, মুখ এত শুকনো কেন?’ ‘মনটা ভালো নেই বউ’। শশী জানায়। কুসুমের গ্রাম্য ‘শরীর’-সর্বস্ব চপলতা যেন জানতে চায় না, শুধু ঠাট্টার ছোট্ট অথচ তীব্র চপেটাঘাত পড়ে শশীর সর্বাঙ্গে – ‘ওমা, কী হল মনের?’
অবশ্য নিঃসঙ্গতা থেকে, কিছুটা আত্মকেন্দ্রিকতা থেকেও, শেষপর্যন্ত বেরিয়ে আসতে হয় শশীকে। তার চোখ ‘খুঁজিয়া বেড়ায় মানুষ’।
৩
যেহেতু কোনও একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে উঠে আসেননি মানিক- যেমন এসেছেন উত্তর রাঢ়ভূমি থেকে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় বা নিম্নবঙ্গ থেকে বিভূতিভূষণ, যেহেতু আজন্ম কোনো একটা স্থায়ী আর নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার সুযোগ মানিক পাননি, সেইহেতু, তাঁর জগৎটিকে আমরা যদি বলি ‘ছিন্নমূল’, খুব অন্যায় বোধহয় হবে না। আর এই জগতের তিনিই প্রথম সন্তান, যিনি বাংলা সাহিত্যে একটা স্থায়ী আসনের দাবিদার হয়ে দেখা দিলেন। বাবার চাকরি-সূত্রে দেশে-দেশে ভ্রাম্যমাণ যে বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভের সন্তানকুল, তাদেরই মনোকাঠামোর শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান তাঁর। তিনি নির্দিষ্ট কোনও ভূখণ্ডের অন্তরাত্মাকে চেনেন না। তাই মানুষের মনের ওপর এতটা প্রাধান্য আরোপ করতে হয় তাঁকে। এমনকি কৈফিয়তও দিতে হয় প্রথম উপন্যাসেই- ‘চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের projection – মানুষের এক-একটুকরা মানসিক অংশ’।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো গ্রামনির্ভর একটা বড়-সড় উপন্যাসেও স্থানীয় কৃষিকাজ নিয়ে সাকুল্যে একটা পাতাও তিনি লেখেন না। নেই কোন স্থানীয় প্রবাদের উল্লেখও। তাঁর নায়ক শশী কলকাতায় পড়তে গিয়ে নবজন্মলাভের পর ফিরে এল নিজের গ্রামে। ঔপনিবেশিক শিক্ষার অন্যবিধ কুফল নিয়ে যে শিক্ষা পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে ধারণ করতে চায় এবং একই সঙ্গে স্বসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আত্ম-উন্নতির স্বপ্নঘূর্ণিতে ঘোরায়, তার মাথা ইউরোপের আর শরীর এই বাংলার। মূলত সে পলায়নপর, অথচ বাধ্যত তাকে থাকতে হল তার গ্রামে। এই যে অবস্থা, মরণশীল অথচ সদাজীবিত বাংলার গ্রাম, এই যে সঙ্ঘাত, শশীকেও একদিন জড়িয়ে পড়তে হল সেই সঙ্ঘাতে- তারই সংলগ্ন আকাশের প্রান্তদেশে যে সূর্যাস্ত, সেই সূর্যাস্তের মৃত্যুরঙিনতা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে। জড়িয়ে পড়তে হল নিঃসঙ্গতার নিষ্পেষণ সত্ত্বেও।
ব্যক্তির মৃত্যু ঘটিয়ে, হয়তো-বা ব্যক্তিসত্তাকে উন্মোচিত করে, সমাজের প্রতি এই যে দায়বোধ মানুষের (এখানে শশীর) – এতে জয় হবে কার? যদি সমাজের জয় হয়, তবে তো মুড়ো-পর্যন্ত জিতে যাবে রাষ্ট্রই! তার বহুবিধ যন্ত্র আবার প্রাণ পাবে। আর সেই রাষ্ট্রই নিজ স্বার্থে মানুষকে কাজে লাগবে। দরকার মতো বাঁচিয়ে রাখবে বা মেরে ফেলবে। গুম করে দেবে। মানুষের, ব্যক্তি-মানুষের, এই অসহায়তার রূপটি যুদ্ধোত্তর ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছিল। তাই সমাজের তখনও পর্যন্ত তৈরি হয়ে থাকা কাঠামোটির রূপ ভেঙে-ভেঙে দেখার নানাবিধ চেষ্টা শুরু হয়। উপন্যাসে, ছোটগল্পে, দর্শনে, ছবিতে আর কবিতাতেও। এমনকী মানুষের মুখের আর লেখার ভাষা-বিশ্লেষণও জরুরি হয়ে পড়ে।
হয়তো তাঁদের দূরপনেয় উদ্দেশ্য ছিল নতুন এক সমাজ তৈরির; কিন্তু আশু উদ্দেশ্য ছিল সমাজের – যে-সমাজ মানুষই গড়ে তুলেছে নিজের অজান্তে – ভয়ঙ্কর দিকগুলো উন্মোচিত করার। রাষ্ট্রের বা ক্ষমতাশালী অংশের নাট-বল্টু যে প্রতিটি মানুষ, যা ছিল নিতান্তই চলাচলের পথ, সেটা যে রাষ্ট্রযন্ত্র অটুট রাখার জন্য কামানবাহী শকটের দখলদারিতে পরিণত হয়েছে কবে যেন, হাসপাতাল তৈরি হয়েছে অসুস্থকে নির্দয়ভাবে জনবিচ্ছিন্ন করবার জন্যে, জেলখানা গড়ে উঠেছে অপরাধী বলে বর্ণিত মানুষদের নিঃসঙ্গ করবার জন্য, এমনকী আবাসিক স্কুলও যে এসবের থেকে মহৎ কোনও উদ্দেশ্যে তৈরি হয়নি, আর সে-সব হয়েছে শিশুদের বাধ্য করে তুলতে, কেননা, তারাই একদিন রাষ্ট্রের বা সমাজের কাজে লাগবে- এসব এবং আরও খুঁটিনাটি মারাত্মক দিকগুলো তাঁরা দেখাচ্ছিলেন। সমাজের আমূল পরিবর্তন যে তাঁদের পক্ষেই শুধু নয়, কোনো একক দর্শনের বা মতবাদের পক্ষেও অসম্ভব – এটা তাঁরা বুঝেছিলেন। আর ব্যাথাতুর বিশ্লেষণে তুলে ধরছিলেন ছোট ছোট বিচ্যুতিগুলো, যেগুলো একদিন মানুষই তৈরি করেছে সমাজের ‘উপকার’এর জন্যে। এইসব মনীষীর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, সমাজকে একতরফাভাবে জিতিয়ে দেওয়া আর চলবে না। বা, সমাজ হয়তো-বা জয়ীর আসনেই চিরকাল থেকে যাবে, কিন্তু, তার বিরুদ্ধে ব্যক্তি-মানুষের সদা সতর্ক থাকা জরুরি।
এইখানে আমাদের শশী অনেকটা পিছিয়ে পড়ে রয়েছে। বাংলার যে- গ্রামসমাজের প্রতি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরিচয়ের টান, সেই টানের মায়া শেষপর্যন্ত অগ্রাধিকার পেয়ে গিয়েছে। যে শশীকে একদিন মনে হয়েছিল অগ্রবর্তীজন, একজন চিন্তক এবং ব্যক্তি মানুষের পতাকাবাহী, সেই শশীই কালক্রমে হয়ে উঠল সমাজের এক মাথা। উপন্যাসের একেবারে শেষে পৌঁছে আমরা জানতে পারি – ‘তালবনে শশী কখনও যায় না। মাটির টিলাটির উপরে উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না’।
এমন পরিসমাপ্তিতে শশীর জন্যে কষ্ট হয় এই ভেবে যে বাংলার ‘দৈব-বাহিত’ হাওয়া তাকেও শেষপর্যন্ত জবড়জং করে তুলল! আর হতাশ হই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যে। শেষ বাক্যে ‘শখ’ শব্দটি লিখে তিনি এত বড় আয়তনের একটি সাহিত্যকর্ম পাঠের উচ্চাশা অনেকটাই ধূলিস্যাৎ করতে পেরেছেন। ‘সূর্যাস্ত দেখিবার শখ’ যার হয়, দীঘা বা পুরী না-গিয়ে সে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পড়তে আসবে কেন? নাকি আমার বাক্যটি হবে এমন যে, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ যারা পড়বে, ‘সূর্যাস্ত দেখিবার শখ’ তাদেরই থাকার অথবা না- থাকার কথা?