এবারের ৭ জানুয়ারীর ডানি নির্বাচনের প্রতিটি পদক্ষেপের মতো বিদেশী পর্যবেক্ষক নিয়েও সরকার মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে।
এই নির্বাচনে গণতন্ত্রকামী দেশগুলোর পক্ষ থেকে কোন পর্যবেক্ষক ছিল না। সরকার তার পরেও বিভিন্ন দেশের প্রায় শতাধিক পর্যবেক্ষক নির্বাচন মনিটরিং করেছেন বলে জানিয়েছে এবং তাদের বক্তব্যও মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে ।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এরা কারা?
সরকারের এমন কু-কৌশলের কারণে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আজ ৮ ডিসেম্বর কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসের টুইটারে বলা হয়েছে-
”বাংলাদেশের ৭ জানয়ারী ২০২৪ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কানাডা সরকার কোন নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রেরণ করেনি। পর্যবেক্ষক হিসেবে চিহ্নত কানাডিয়ান নাগরিকদ্বয় স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। নির্বাচন বিষয়ে তাদের প্রদত্ত মতামতের সাথে কানাডা সরকারের কোন সংশ্রিষ্টতা নেই।”
এটাই মুটামুটি গণতন্ত্রকামী বিশ্বের অবস্থান। তার পরেও বিপুল পর্যবেক্ষকের নামে যে সব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তা মূলত সরকারের তরফে ডেকে আনা ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত মতামত। সেইসব ব্যক্তিদের বেশির ভাগই সরকারের শেকানো বুলিেআউড়েছেন তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ সরকারের এই সাজানো নাটকের বিরুদ্ধে বলেছেন। যেমন ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক জেজ কৌলসন এক মিডিয়ার সাথে কথা বলার সময় মন্তব্য করেছেন-
“বাংলাদেশে উত্তর কোরিয়া মডেলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের আমন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক জেজ কৌলসন। নিজেকে পর্যবেক্ষক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আই ফাউন্ড দ্য নর্থ কোরিয়া মডেল হিয়া’র।”
রবিবার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আঙিনায় বাংলা আউটলুকের সঙ্গে সাক্ষাতকারে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
তবে দেশের বাইরে থাকা অনেক থিংকট্যাঙ্ক এই নির্বাচনকে সর্বনাশা পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন। বিদেশী মিডিয়াতে এই নির্বাচন নিয়ে যে ধরণের প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে এবং তাতে যেসব মন্তব্য কোট করা হয়েছে তা বিশ্ব মতামত যে এই নির্বাচনকে বর্জন করেছে তা স্পষ্ট ভাবেই প্রকাশিত হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে বেপরোয়াভাবে চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু, এর মধ্য দিয়ে সরকার মূলত নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান এমন মন্তব্য করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (বাংলাদেশ সময় ০৭ জানুয়ারি) তিনি লিখেছেনঃ গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা মার্ক্সের (কার্ল মার্ক্স) সেই উক্তি-ই স্মরণ করিয়ে দেয়: “ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে-প্রথমে ট্র্যাজেডি আকারে, দ্বিতীয়বার প্রহসনরূপে।” এর আগে দুটি কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের পর সরকার এখন বেপরোয়াভাবে তৃতীয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করছে-কিন্তু সরকার মূলত নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করছে।
নির্বাচনের আগের দিন (০৬ জানুয়ারি) আরেকটি পোস্টে কুগেলম্যান লিখেছিলেনঃ আগামীকালের নির্বাচন যতো না বাংলাদেশের নির্বাচন, তারচেয়ে বেশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলটির নির্বাচন হবে। কোনো সত্যিকারের বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এই নির্বাচন মূলত সংসদকে সাজাবে যেখানে আওয়ামী লীগ তার আধিপত্য বজায় রাখবে।
এ রকম আরও বহু মতামত উল্লেখ করা সম্ভব। সব মিলিয়ে সরকার চিন ও রাশিয়ার বাইরে আর কোন দেশকে প্রকাশে এই নির্বাচন নিয়ে প্রশংসা করার জন্য পায় নি। তাই বিভিন্ন দেশ থেকে শতাধিক ব্যক্তিকে এনে তাদের দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়ে সরকারী ভাষ্য তাদের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে সেটাকেই বিদেশীদের অভিমন হিসেবে প্রচারের নোংড়া কৌশল নিয়েছে সরকার।
বিদেশী নাম ও ইউরোপ আমেরিকার নাগরিকদের মুখ থেকে এমন মন্তব্য শুনে জনমনে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। সাধারণ মানুষ নির্বাচন বর্জন করে সরকারকে যে বার্তা দিয়েছে আর বিদেশীদের মুখে উল্টা কতা শুনে বিভ্রন্ত হওয়ার পরে এখন দেশগুলোর তরফে সেইসব ব্যক্তিদের সাথে তাদের রাষ্ট্রীয় মতামতের কোন সম্পর্ক নাই মর্মে বক্তব্য প্রদানের পরে -এই সব কূটকৌশল ভেস্তে গেছে। মানুষ এখন বুঝতে পারছেন- এগুলো সরকারের টাকায় বাংলাদেশে এসেছে লিপ সার্ভিস দিতে- এমন মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্রেষকরা।
সোসাল মিডিয়াতে এগুলো নিয়ে সরস কৌতুক জমে উঠেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অন্য অনেক কু-কৌশলের মতোই এই ফেইক পর্যবেক্ষক নাটকটিও অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে গেল। মানুষ এর গোমর বুঝে গেছে।
অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ছাড়াই জয়লাভ করায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারত, চীন, রাশিয়াসহ সাত দেশের রাষ্ট্রদূতেরা।
আজ সোমবার সকালে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারত, রাশিয়া, চীন, ভুটান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূতেরা। এ সময় তাঁরা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। এর বাইরে আর কোন দেশকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই।
এই নির্বাচন বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। দেশকে আরও গভীর অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবে। নাগরিকরা মনে করেন, দ্রুত পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন বিকল্প নাই।