বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের বিপরীত ঢেউ

0
76

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আবির্ভূত হওয়া স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো ছিল হয় পার্টি, না হয় সামরিক জান্তা দ্বারা পরিচালিত। মোটাদাগে সেগুলো ছিল যৌথ নেতৃত্ব। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের উত্থান শুরু হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই শাসন এবং গণতন্ত্রের পশ্চাদ্‌যাত্রা নিয়ে লিখেছেন আলী রীয়াজ।

২০২৪ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বের ৬৪টি দেশে এ বছর নির্বাচন হবে। ইতিমধ্যেই কোথাও কোথাও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর ৪৯ শতাংশ মানুষ তাঁদের জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য ভোট দেবেন—এমনটাই কথা রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আগে একই বছরে এতগুলো দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘটনা ঘটেনি।

এ তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় বড় দেশ। ভোটার সংখ্যার বিবেচনায় ভারতের নির্বাচনকে বিবেচনা করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় নির্বাচন। আর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি সবচেয়ে বড়। ২৭টি দেশে এই নির্বাচন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্রে সীমিত থাকে না বলে সবার চোখ এ নির্বাচনের দিকেও।

সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী হবে—এ বিপুলসংখ্যক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে যেমন মনে করা হচ্ছে; একই সঙ্গে এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলোচিত হচ্ছে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্রের পশ্চাদ্‌যাত্রার বিষয়। ২০০০ সালের প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। কেননা, এ সময়ে গণতন্ত্রের গুরুতর অবনতি দেখা গেছে।

স্যামুয়েল পি হান্টিংটন যাকে গণতন্ত্রের ‘তৃতীয় ঢেউ’ বলে বর্ণনা করেছেন, সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তারের প্রায় তিন যুগ পার হয়েছে। এরপর ‘তৃতীয় বিপরীত ঢেউ’ পুরো বিশ্বকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আগের দুটি ঢেউয়ের ব্যাপ্তি ছিল ১৮৮২ থেকে ১৯২৬ এবং ১৯৪৫ থেকে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তখনো সমানভাবে বিপরীত ঢেউ এসেছিল। সে সময় বিপরীত দিকে যাওয়া দেশগুলো গণতন্ত্র থেকে সরাসরি স্বৈরতন্ত্রের দিকেই চলে গিয়েছিল। এর মাঝামাঝি কোনো ধূসর এলাকা ছিল না।

গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রপঞ্চ দিয়ে গণতন্ত্রের তৃতীয় বিপরীত ঢেউকে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো হচ্ছে ‘ভুয়া গণতন্ত্র’ ও ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রের উত্থান’।

‘ভুয়া গণতন্ত্র’ হচ্ছে এমন ব্যবস্থা, যেখানে গণতন্ত্রের কিছু ছিটেফোঁটা থাকে। যেমন নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিরোধী দলগুলোর জন্য সীমিত পরিসর থাকে। কিন্তু শাসনব্যবস্থার মূল রূপটি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী। এই ভুয়া গণতন্ত্রকে হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা শাসনব্যবস্থাও বলা হয়। দোআঁশলা শাসনব্যবস্থায় যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা সংবিধানকে তাঁদের সুবিধামতো ব্যবহার করেন। নির্বাচনে এমন কায়দায় কারচুপি হয় যে নির্বাচন আর গণতন্ত্রের অংশ না হয়ে ক্ষমতাসীনদের আইনি বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

এই শাসকেরা এমন প্রক্রিয়ার সূচনা করেন, যা ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এই শাসকেরা দাবি করেন যে তাঁদের গণতন্ত্র একটি ভিন্ন ধরনের গণতন্ত্র। তাঁরা বাক্‌স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিনিধি বাছাই এবং জবাবদিহির মতো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানগুলোকে কাটাছেঁড়া করার জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেন সংস্কৃতি ও ধর্মকে।

কয়েক বছর যাবৎ এ ধরনের সরকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা, নাগরিকেরা গণতন্ত্রের ধারাবাহিক পতন ও অবক্ষয়ের এসব দিকে উপেক্ষা করেছেন। পাশাপাশি ভুয়া গণতন্ত্রের দেশগুলো কখনো কখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছে। এই শাসকদের বহিরাগত মদদদাতা রয়েছে, যারা যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। বহু দোআঁশলা শাসনব্যবস্থা কয়েক যুগ যাবৎ স্বৈরতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মাঝখানে ধূসর এলাকায় অবস্থান করছে। কিছু কিছু ইতিমধ্যেই স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি দেশে সফলভাবে গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র কী

দ্বিতীয় প্রপঞ্চ, অর্থাৎ ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র’ বৈশ্বিক দৃশ্যপটে ধারাবাহিকভাবে আবির্ভূত হয়ে আমাদের নজর কেড়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮৮ সালে সব স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে ২৩ শতাংশ ছিল এ ধরনের। ২০১০ সালের মধ্যে সেটা দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। এক অর্থে ব্যক্তিবাদিতা বা ‘পারসোনালিজম’ রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সম্প্রতি যা একে বিশেষভাবে লক্ষণীয় করে তুলেছে, তা হচ্ছে এটি একটি শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। অন্য কথায়, এটি বিদ্যমান সরকারগুলোর একটি ধরনে পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবির্ভূত হওয়া স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো ছিল হয় পার্টি, না হয় সামরিক জান্তা দ্বারা পরিচালিত। মোটাদাগে সেগুলো ছিল যৌথ নেতৃত্ব। ১৯৮০ সালের শেষ নাগাদ এটাই ছিল প্রধান প্রবণতা। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝিতে গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এ বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের উত্থান শুরু হয়।

এক দশক যাবৎ এ প্রপঞ্চ নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে আছেন আন্দ্রে কেন্ডেল টেলর, কারিসা নিশে, এরিকা ফ্রাঞ্জ ও জোসেফ রাইটের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাঁরা ব্যক্তিবাদিতাকে ‘রাজনৈতিক পরিসরে একক ব্যক্তির আধিপত্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিবাদী নেতারা নিজ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় আধিপত্য বিস্তার করেন। এর ফলে এই ব্যক্তিরা যে সরকার পরিচালনা করেন, তার সঙ্গে তাঁরা কার্যত ‘অবিভাজ্য’ হয়ে যান।

এরিকা ফ্রাঞ্জ এক জায়গায় এ ধরনের রেজিম বা সরকারকে ‘ব্যক্তিবাদী একনায়কত্ব’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনামতে, ব্যক্তিবাদী একনায়কত্ব বলতে এমন সরকারগুলোকে বোঝানো হচ্ছে, যেখানে ক্ষমতা কোনো একটি রাজনৈতিক দল, রাজপরিবার বা সামরিক জান্তার পরিবর্তে এক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত থাকে। সবাই জানেন, স্বৈরতান্ত্রিক নেতাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কেন্দ্রীভূত ও একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাঁরা তাঁদের নির্দেশনার প্রতি প্রশ্নাতীত বশ্যতা ও ব্যক্তিগত আনুগত্য দাবি করেন। এটা স্পষ্ট, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার শীর্ষে ‘ব্যক্তিবাদী একনায়ক’ রয়েছেন, সেটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারীরা কীভাবে শাসন করেন

এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার কীভাবে দেশকে শাসন করে? আলেকজান্ডার বাটুরো ও জ্যাকব টোলস্ট্রুপের মতে, এই নেতারা সব সময় কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করেন না। এর বদলে এমনকি যদি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেও থাকে, তারা ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট’ (পোষক–আশ্রিত) সম্পর্ক এবং শাসনব্যবস্থার অপ্রাতিষ্ঠানিক (ইনফরমাল) রাজনীতির ওপর নির্ভর করে।

একাটেরিনা শুলম্যান রুশ রাজনৈতিক চালচিত্র বর্ণনা করার সময় প্রতিষ্ঠান ও নেতার সম্পর্ক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাকে একজন নেতা বা তাঁর নিকটতম সহযোগীদের হাতে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর, ধ্বংস অথবা নকল করে।

কেন্ডেল টেলর ও তাঁর সহকর্মীরা বলেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রে একজন ব্যক্তি সব প্রতিষ্ঠান ও নিয়মকানুনকে টপকে যান। তাঁরা লিখেছেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রে শীর্ষ নেতা বাদবাকি ক্রীড়নকদের সব রকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে দেশ পরিচালনা করেন। এমনকি নেতার রাজনৈতিক দল (যদি তা থাকে) বা নিরাপত্তা বাহিনীও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। ফলে নীতি নির্ধারণে শাসকের খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের নীতি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিষয়ে বড় ধরনের ঐকমত্য আছে—যেকোনো ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ নীতি তৈরি হয় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এ পলিসি বা নীতি কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা শাসনব্যবস্থার মধ্যে সীমিত নয়, বরং এগুলো পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের সঙ্গেও সম্পর্কিত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারদের মধ্যে ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণের প্রবণতা দেখা যায়।

২০১৭ সালে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত এক পুস্তিকায় টোরি টাউসিগ ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারদের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির চারটি কারণ (ফ্যাক্টর) চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘উচ্চাভিলাষী, নির্মম ও বিভেদমূলক’। দ্বিতীয়ত, এই নেতারা যুদ্ধের ঝুঁকি কম বলে মনে করেন। তৃতীয়ত, তাঁকে জবাবদিহি করতে পারে—এমন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির কারণে তিনি পরাজয়ে ভয় পান না। চতুর্থত, অধীনস্থরা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় একটি ‘গ্রুপথিঙ্ক’ বা সবাই একই ধরনের চিন্তার অনুসারী হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

অন্য বিশেষজ্ঞরাও উল্লেখ করেছেন যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কতন্ত্র আসলে অন্য একনায়কদের মতো পারমাণবিক অস্ত্রে বিনিয়োগ করতে চায় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সম্পর্কে কম অংশ নিতে চায়। এ ধরনের শাসকেরা ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে এমন ধরনের ক্রোনি সিস্টেম গড়ে তোলেন, যেগুলো জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হয় এবং সব ধরনের জবাবদিহি থেকে সুবিধাভোগীদের রক্ষা করে। পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করা হয় এই বিবেচনায় যে বাইরে থেকে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে কারা তাদের ঢাল হিসেবে কাজ করবে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের উত্থান কীভাবে ঘটে

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারীদের উত্থান অকস্মাৎ ঘটে না; ধীরে ধীরে তাঁদের উত্থান ঘটে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে তাঁরা পাটাতন হিসেবে কাজে লাগিয়ে সমাজে ক্ষতিকর মেরুকরণ গড়ে তোলেন এবং নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা যে পথ অবলম্বন করেন, তাকে স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলেট ‘গণতন্ত্রের মৃত্যুর পথ’ বলে বর্ণনা করেছেন। হাউ ডেমোক্রেসিস ডাই গ্রন্থে তাঁরা স্বৈরাচারের উত্থানের তিন ধাপের প্রক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রথম ধাপ হলো, রেফারিকে টার্গেট করা (অর্থাৎ ‘বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা, কর নিয়ন্ত্রক সংস্থা’ দখল)। দ্বিতীয় ধাপ হলো, বিরোধীদের টার্গেট করা (দমননীতি ও আইন ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে মিডিয়া, সুশীল সমাজ পর্যন্ত সব ভিন্নস্বরকে নিশ্চুপ করা) এবং তৃতীয় ধাপ হলো, খেলার নিয়ম বদলে দেওয়া (আইনসভা কীভাবে কাজ করবে, নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে—এসব নির্ধারণকারী নিয়মকানুন বদলে দেওয়া)।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের উত্থান ঘটে প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসের মাধ্যমে। এতে নেতার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। প্রথমে বাস্তবে, পরে এ ব্যবস্থাকে আইনি বা সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার জন্য নেতার অধীন নিয়ে আসা সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়। বিরোধীদের দুর্বল বা প্রয়োজনে নির্মূলের মাধ্যমে এবং সংবিধান ও আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে এমন এক ‘প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা হয়, যা কেবল তার নিয়ন্ত্রণেই থাকে। আইন-আদালত ব্যবহার করে বিরোধী দল বা প্রার্থীকে বহিষ্কার করাসহ নানা কায়দায় নির্বাচনে কারচুপি করা হয়। এগুলো করা হয় গোপনে ও প্রকাশ্যে, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে, জোরজবরদস্তি ও ‘কো-অপটেশন’কে ব্যবহার করে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের উত্থানের কালে করণীয়

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারেরা ভোটারদের পাত্তা দেন না। সমালোচকদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং জনসাধারণের অনুভূতিকে অবজ্ঞা করেন। এসব সত্ত্বেও তাঁরা তোষামোদ প্রত্যাশা করেন এবং তাঁদের ‘সফলতার’ জন্য প্রশংসা শুনতে চান। তাঁরা শুনতে চান তাঁদের এ পর্যন্ত পৌঁছানো আসলে তাঁদের সক্ষমতা ও বিরোধীদের ব্যর্থতারই প্রমাণ।

এ ধরনের প্রশংসায় যা থাকে না, তা হচ্ছে, কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেআইনিভাবে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তোষামোদকারীরা এটা পুরোপুরি উপেক্ষা করে। ঠিক এভাবেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারেরা তাঁদের শাসন যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিসর ও সুশীল সমাজের সব ভিন্নমতকে নীরব করে দিয়েছে—সে শাসনের বৈধতা খোঁজেন।

এ ধরনের বিজয়কে আপাতদৃষ্টে মনে হয় কৌশলগত চিন্তা ও সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্জিত। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় ‘পিরিক ভিক্টোরি’। এটা এমন এক বিজয়, যা অর্জিত হয়েছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।

চড়া দামে অর্জিত এ বিজয়ের মূল্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে জাতিকেই বহন করতে হয়। ফলে এই নেতারা তাঁদের সাফল্যের জন্য জনগণের অভিনন্দন পেতে পারেন না। এ পরিস্থিতিতে বরং নাগরিকদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের উত্থান জাতিকে খাদের কিনারায় নিয়ে যায়। এসব কথা বলতে না পারা পর্যন্ত ‘নীরবতাই শ্রেয়’ হচ্ছে ভালো বিকল্প।

লেখকঃ আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here