৭ জানুয়ারির পর ১৯ দিনে জামিন ৩১০ জনের * এক মামলায় বাধা কাটলেই মুক্তি মির্জা ফখরুল ও আমির খসরুর * নির্বাচনের পর নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণায় একটু স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে- আইনজীবী
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের কয়েক মাস বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনায় সরকার পক্ষের আইনজীবীদের (প্রসিকিউশন) ব্যাপক তৎপরতা থাকলেও এখন অনেকটাই ভাটা।
নতুন বছরের প্রথম ২৬ দিনে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন ১৮ মামলার রায় পিছিয়েছে। পাশাপাশি জামিন পাচ্ছেন কারাবন্দি অনেক নেতা। নির্বাচনের পর মামলার বিচারে ধীর গতির বিষয়টি আমলে নিতে নারাজ সরকার পক্ষের আইনজীবীরা। তারা মনে করেন, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
যদিও জামিন লাভের পর কোনো কোনো নেতা আপিল বিভাগের জামিন সংক্রান্ত ওকালতনামা দাখিলের পরও কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তাদের স্বজনদের।
ঢাকার বিভিন্ন আদালতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলাগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের শেষ পাঁচ মাসে ১১৩ মামলায় অন্তত ১ হাজার ৭৫১ বিএনপি নেতাকর্মীর সাজা হয়। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরেই ৬৭ মামলায় ৯৯৭ জনের সাজা হয়। তবে ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো নেতার বিরুদ্ধে সাজা বা রায় ঘোঘণা করা হয়নি বলে জানা যায়।
১ জানুয়ারির পর যেসব মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ছিল তার সবকটি পিছিয়েছে। এসব মামলায় রায় কবে দেওয়া হবে তাও নির্ধারণ করা হয়নি। পুলিশের ওপর হামলা, কর্তব্যকাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার অভিযোগে মামলাগুলো করা হয়েছিল।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, নির্বাচনের পর নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণায় একটু স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিচারাধীন সব মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলাগুলোর বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতে কোনো আসামির সাজা দেওয়ার বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। এতে কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয় নেই।
ঢাকার বিভিন্ন আদালতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলাগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের আগেই অনেক রায় হয়ে গেছে। তখন প্রতিদিনই নেতাদের মামলায় রায় হলেও নির্বাচনের পর সেভাবে শুনানি দ্রুত করা বা রায়ের তারিখ পড়ার ঘটনা ২৫ দিনেও ঘটেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২১ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালতে শাহবাগ থানার এক মামলায় রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল, রায় হয়নি।
১৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় ঘোষণার পরবর্তী দিন ধার্য করেন আদালত। এ মামলায় বিএনপির হাবিবুন-নবী-খান সোহেল, সাইফুল আলম নীরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ইসহাক সরকার, নবী উল্লাহ নবীসহ ৭৭ জন নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে আদালতে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মইনুল ইসলামের আদালতে ১৪ জানুয়ারি চকবাজার থানার একটি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। পরবর্তীতে রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শান্ত ইসলাম মল্লিকের আদালতে কাফরুল থানার (মামলা নং-৩ (৩) ১৫) মামলার রায় ঘোষণা করার কথা ছিল ১১ জানুয়ারি। এ মামলায় রায় পিছিয়েছে। এ মামলায় আসামির তালিকায় আছেন বিএনপির হাবিবুন-নবী-খান সোহেল, শিমুল বিশ্বাস, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, রাজীব আহসানসহ শতাধিক নেতাকর্মী।
এছাড়াও গত ২ জানুয়ারি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে গুলশান থানায় নাশকতার অভিযোগে করা এক মামলা ও ২০১০ সালের আগস্ট মাসে উত্তরা মডেল থানার এক মামলা, গত ৩ জানুয়ারি মতিঝিল, চকবাজার, কোতোয়ালি থানার তিনটি মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা ছিল। এ পাঁচ মামলার রায় ঘোষণার তারিখও পিছিয়েছে। এসব মামলার রায় ঘোষণার জন্য পরবর্তী তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট তাপস কুমার পাল বলেন, আসামিকে সাজা দেওয়ার বিষয়টি বিচার প্রক্রিয়ায় চলমান। এটা উদ্দশ্যপ্রণোদিত না। সাজার বিষয়ে হয়তো মামলাগুলোর কিছু প্রক্রিয়া বাকি আছে। তাই ঘোষণা হচ্ছে না। বিচারকদের তো অনেক কাজ থাকে। যখন যেটা সামনে এসেছে তার রায় হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির নেতাদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় যুক্ত আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেসবা বলেন, নির্বাচনের পর রায় ঘোষণার গতি একটু শ্লথ হলেও বিচারাধীন সব মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যে মামলার রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়েছে, সেগুলোকে পরবর্তীতে কোনো হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার কায়সার কামালক বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে যে মামলাগুলো দেওয়া হয়, সব মামলাই মিথ্যা। নির্বাচনের আগে প্রতিদিন রায় ঘোষণা এবং নির্বাচনের পর রায় ঘোষণা বন্ধ রেখে জামিন দেওয়াই প্রমাণ করে মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায়ই মামলাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। দেশে আইনের শাসন বলতে যে বিষয়টা থাকার কথা, সেটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বিএনপির দাবি, ২৮ অক্টোবরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ১ হাজার ১৭৫ নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। আসামির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার বিএনপি নেতাকর্মী। ২৭ হাজার ৪৮৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর আদালতে বারবার জামিন আবেদন করলে নামঞ্জুর হয়ে যায়। ৭ জানুয়ারি ভোটের পর ধীর গতিতে হলেও জামিন পাচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার তথ্যমতে, ঢাকার ৫০টি থানায় নাশকতার বিভিন্ন মামলায় নির্বাচনের পর প্রায় ৩১০ জন নেতাকর্মী জামিন পেয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়।
এর মধ্যে গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টন মডেল থানার এক মামলাসহ ১০ মামলায় জামিন পেয়েছেন তিনি। তবে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় ওইদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামিন দেননি হাইকোর্ট। এ মামলায় জামিন না হওয়া পর্যন্ত কারামুক্ত হতে পারছেন না তিনি। এ মামলায় জামিন পেলেই মুক্ত হতে পাবেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়। এর মধ্যে বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলা ছাড়া বাকি ৯ মামলায় জামিন পেয়েছেন তিনি। এ মামলায় জামিন পেলে কারামুক্তি পাবেন এই নেতা।
মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে শাহজাহানপুর থানার এক মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরীর আদালতে তার বিরুদ্ধে বাকি ১০ মামলায় গ্রেফতার ও জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়।
পাশাপাশি জহির উদ্দিন স্বপনের বিরুদ্ধে রমনা ও পল্টন থানার ৫ মামলায় গ্রেফতার ও জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি থানার দুই মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও সাবেক সংসদ-সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির নেতাদের পক্ষে মামলা পরিচালানায় যুক্ত আইনজীবী শেখ শাকিল আহমেদ রিপন যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এই পরিকল্পিত গ্রেফতার, তাই এখন নির্বাচন শেষ হওয়ায় কিছু কিছু নেতাকর্মী জামিন পাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট তাপস কুমার পাল বলেন, দেশে রাজনৈতিক মামলা বলতে কিছু নাই। স্বাভাবিকভাবে যখন দেশে একটু উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থাকে, তখন সব আসামিরই জামিন কম হয়। এটা স্বাভাবিক। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে তখন আদালত হয়তো বিবেচনা করে জামিন দেন। এটা বিচারকের ওপর নির্ভর করে।