একদফা দাবিতে ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে বিএনপিসহ মিত্ররা। এতে নির্বাচন বর্জন করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও পাশে চায় তারা। এর ধরন কী হবে, তা নিয়ে আলোচনাও চলছে। জানুয়ারির শুরু থেকে সব বিরোধী দলের সঙ্গে সমন্বয় করে এ কর্মসূচি পালনের চিন্তাভাবনা চলছে। এর আগে হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি ভোটদানে ‘নিরুৎসাহিত’ করার কর্মসূচি দেওয়া হবে। ভোটারদের কাছে নির্বাচন ‘আগ্রহহীন’ করতে চান তারা। এজন্য হরতাল ও অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে সারা দেশে ভোটবিরোধী লিফলেট বিতরণসহ জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নেতারা মনে করছেন, জনগণ ভোট প্রত্যাখ্যান করা মানে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অসহযোগিতা করা। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ভোটারদের উদ্দেশে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানানো হতে পারে। একই সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচিসহ নানা দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেওয়ার কথাও রয়েছে হাইকমান্ডের। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তখন দেশবাসীকে অফিস-আদালতে না যাওয়া, যান চলাচল বন্ধ রাখা, কলকারখানা বন্ধ রাখা তথা সরকারকে সর্বাত্মকভাবে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানাতে পারে বিরোধী দলগুলো। এর মাধ্যমেই মূলত ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের সূচনা করার পরিকল্পনা তাদের। তবে বর্তমান বাস্তবতায় এই অসহযোগিতার আহ্বান কতটা মাঠে বাস্তবায়ন সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট এবং জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আজ ভার্চুয়ালে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চলমান আন্দোলনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারে বিশ্বাসী দেশের সরকার বিরোধী সব রাজনৈতিক দল যুগপৎ ধারায় রাজপথে নেমেছে। সরকার যতই নির্যাতন-নিপীড়ন চালাক, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভোট বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাবেন। পাশাপাশি ভোটে সহযোহিতা না করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতিও আহ্বান জানাবেন। এছাড়া আন্দোলন নিয়ে নতুন ভাবনার কথা বলবেন। একই সঙ্গে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থে নির্বাচন বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলোকে এক কাতারে আসারও আহ্বান জানাতে পারেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন বয়কট করে একদফার আন্দোলনে থাকা বিএনপির লক্ষ্য এখন ভোট ঠেকানো। এ লক্ষ্যে এবার সর্বাত্মক আন্দোলনে নামছে দলটি। এর সঙ্গে নির্বাচনে ভোটার ঠেকানোরও পরিকল্পনা করছে তারা। এর অংশ হিসাবে হরতাল-অবরোধ শক্তভাবে পালনের পাশাপাশি জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশবাসীকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র তৈরি করা হচ্ছে। দুই পাতার প্রচারপত্রে এক পাতায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এবং অপর পাতায় আসন্ন নির্বাচনকে একতরফা, ডামি নির্বাচন হিসাবে উল্লেখ করে কেন এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবেন, সে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। শুক্র অথবা শনিবার থেকে এই প্রচারপত্র বিতরণের কাজ শুরু হতে পারে। ভোটের দিন ৭ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত সারা দেশে ভোটবিরোধী এ প্রচারপত্র বিলি করা হবে।
জানা যায়, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য জোট ও দল পৃথক প্রচারপত্র বিলি করবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ইতোমধ্যে ‘প্রহসনের নির্বাচন বর্জন কর, দুঃশাসন হটাও’ আহ্বান সংবলিত প্রচারপত্র তৈরি করে বিলি শুরু করেছে। মঙ্গলবারও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনই পির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমও ‘একতরফা’ নির্বাচনে অংশ না নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও মিত্ররা। এজন্য আগামী দিনে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, পথসভা, উঠান বৈঠক, পোস্টার, লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে জনমতকে সংগঠিত করার পরিকল্পনা করছে। এ কাজে সারা দেশের জেলা, উপজেলা ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করা হবে। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনগণকে অব্যাহতভাবে ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হবে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণাকেও গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি। এতে ‘একতরফা’ নির্বাচনে জনগণের ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব, ভোটাধিকার হরণ, আন্তর্জাতিক বিশ্বে নেতিবাচক সম্পর্ক তৈরির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও এ ধরনের নির্বাচনের প্রভাবে দেশের শিল্প-বাণ্যিজ্যে ‘পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার’ শঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করা হচ্ছে জনগণকে।
বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, তাদের ধারণা বর্তমানে দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও বাংলাদেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মোটেও সরে যায়নি। তাই তাদের এখন চেষ্টা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর ভোটাররা বর্জন করলেই নির্বাচন কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। একই সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে না গেলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের চূড়ান্ত অনাস্থার বিষয়টিও প্রতীয়মান হবে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমাসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বে নির্বাচন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমনটা হলে নির্বাচন করতে পারলেও আওয়ামী লীগের জন্য সরকারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, একতরফা ও ভাগবাঁটোয়ারার নির্বাচনের যে আয়োজন চলছে, তা এরই মধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশের বেশির ভাগ জনগণ। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ডাক অব্যাহত রাখব। একদিকে যেমন হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি থাকবে, পাশাপাশি দেশের প্রতিটি ঘরে এই প্রত্যাখ্যানের ডাক পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে প্রচারপত্রসহ বিভিন্ন প্রচার উপকরণ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করব। পাশাপাশি সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, পথসভা, উঠান বৈঠক, খণ্ড মিছিলের মতো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভোটে না গিয়ে তা চূড়ান্ত বর্জনের জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানানো হবে। সহিংসতা-উসকানিতে পা না দিয়ে যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ পথে আমরা এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে চাই।
তিনি আরও বলেন, মানুষ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে, ভোট প্রত্যাখ্যান-বর্জন করার মধ্য দিয়েও নির্বাচনের প্রতি তাদের অসহযোগিতা ব্যক্ত করতে পারে। অসহযোগিতার ক্ষেত্র-পরিধি আরও বিস্তৃত হবে কি না, মাত্রা ও গভীরতা কেমন হবে-সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। যেভাবে নির্বাচন নামে তামাশা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে, তাতে রাজপথে মানুষের গণবিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।