“মূল্যবোধ ধ্বংস হয়েছে, আইনের অপব্যবহার হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকরণ হয়েছে এবং দুর্নীতি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায়, নির্বাচনে জয়ী হলেও চরম মূল্য দিতে হতে পারে আওয়ামী লীগকে।”
(আওয়ামী লীগ হয়তো জিতবে, কতটা মূল্য দিতে হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে-
মাহফুজ আনাম, ২ ডিসেম্বর,২০২৩, দ্যা ডেইলি স্টার)
উপরের কথাগুলো কি জনাব মাহফুজ আনাম লিখেছেন? আমাদের সন্দেহ জাগে। কেন না ঠিক এর পরের সপ্তাহে দ্যা ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ৭ ডিসেম্বর তার সম্পাদিত পত্রিকাতে একটি সম্পাদকীয় কলাম লিখেছেন , সেটা পড়ার পরে আমাদের মনে সন্দেহ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, এই দুটো লেখা কি একই মাহফুজ আনামের? সাত দিনের ব্যবধানে কি এমন ঘটলো যে তিনি এমন উল্টে গেলেন। রাজনীতিতে পুরোপুরি উল্টো পথে হাঁটার নজির আছে। কিন্তু সাংবাদিকতায় এই নজির তৈরি হলে তা খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। মাহফুজ আনামও এই আমলের ফ্যাসিবাদের একজন ভিকটিম। উনার লম্বা সাংবাদিকতার জীবনে এতোটা অপমাণিত ও হয়রানির শিকার হতে হয়নি যতটা এই আওয়ামী আমলে হয়েছে। তার পরেও এই উল্টা সুরে গান ধরার রহস্য আামাদের হতাশ করে। তিনি কি নতুন করে আবার কোন পরিস্থিতির শিকার হলেন!
তার এই বছরের ৭ ডিসেম্বরের লেখায় তিনি মন্তব্য করেন,
‘বিএনপি কি তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশার সম্মান রাখছে?’
এবং এইভাবে আন্দোলনে যাওয়াকে তিনি চরম ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। প্রথম কথা হলো- আরও তীব্র আন্দোলন ও সর্বাত্বক আন্দোলনের জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীরা আরও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ফলে এই আন্দোলনের পথে হাটা সাধারণ মানুষ ও তৃণমূলের নেতাদের চাওয়ার বহিঃপ্রকাশ যা মাহফুজ আনাম বুঝতে পারছেন না।
তিনি মন্তব্য করেছেন,
“যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্তুতি ছাড়াই যে বিএনপি আন্দোলনে নেমেছে তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গত বছরের শেষ দিকে যে বিপুল জনসমর্থন সৃষ্টি করতে পেরেছিল তা থেকে বিএনপি অর্থবহ ফসল ঘরে উঠাতে ব্যর্থ হয়েছে।”
তিনি আরও মন্তব্য করেছেন,
“বিএনপির আরেকটি মারাত্মক ভুল হচ্ছে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা না রাখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি জানানো হলে এর প্রতিক্রিয়া যে কঠোর কিছু হবে, তা অবধারিতই ছিল। কিন্তু কঠোর পরিস্থিতি এলে কীভাবে টিকে থাকা যাবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা তাদের ছিল না।”
জনাব মাহফুজ আনাম মন্তব্য করেছেন, “নিশ্চিত জয়ের নিশ্চয়তা ছাড়া নির্বাচনে যাওয়াটাকে অর্থহীন মনে করে বিএনপি”। -এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় তিনি বিএনপিকে আওয়ামী লীগের চোখ দিয়েই দেখেন। বিএনপি তীব্র আন্দোলন করলে তারা সহিংসতার বয়ান তুলে দমন করেন। আর শন্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে বিএনপি আন্দোলন করতে অক্ষম, আন্দোলনের মুরোদ নাই এমন জিকির তুলেন। আর বিএনপির প্ল্যান বি, সি, ডি এগুলোর কোন দরকার নাই। কারণ মানুষ জানে শেখ হাসিনা ও ভোটাধিকার দুইটা এক সাথে হতে পারে না। ফলে শেখ হাসিনার কল্পিত ইমেজ ধ্বংস হয়ে দানবীয় রুপটা প্রকাশ হওয়া এবং এটাকে পরাজিত করাই জনগনের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার একমাত্র পথ-এটা নিয়ে কোন সন্দেহ বা দ্বিমতের সুযোগ নাই। আর এটাই চোরা আওয়ামী লীগারদের অস্বস্তির কারণ।
প্রশ্ন হল, জনাব আনাম কি তাহলে অবশেষে শাহজাহান ওমর সিনড্রমে আক্রান্ত হলেন! শাহজাহান ওমর সাহেবও সবাইকে চমকে দিয়ে নৌকায় উঠে পড়েছেন। একইভাবে জনাব মাহফুজ আনামও এক সপ্তাহের ব্যবধানে আওয়ামী নেতাদের খোড়া যুক্তিগুলো তার কলামের নামে জাতির সামনে হাজির করলেন! কি বিচিত্র এ দেশ!
সরকার দমন পীড়ন চালালে কীভাবে টিকে থাকবে সেই পরিকল্পনা নিশ্চয়ই বিএনপির আছে। গত ১০ ডিসেম্বরে সারা দেশে নেতাকর্মী ও জনসাধারণের জমায়েত দেখে লীগ ও জনাব মাহফুজ আনাম সাবেহরা আশা করি বুঝতে পারছেন আওয়ামী লীগের গণহারে গ্রেফতার ও ক্র্যাকডাউন কাজে আসে নাই। বিএনপি, শুধু আড়ালেই থাকে না, সরবে মাঠেও আছে।
বিএনপি কোন গোপন-বিপ্লবী গেরিলা চরমপন্থী রাজনীতি করে না। ফলে বিএনপি আন্দোলন গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পথে পরিচালিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাই দলের নীতিগত অবস্থান। বল প্রয়োগ, আইনের সন্ত্রাসী কায়দায় ব্যবহার- এগুলো আওয়ামী লীগের চিরাচরিত কৌশল। এখন মানুষ বুঝেন কারা সহিংসতা করেন, কারা গাড়িতে আগুন দেয়। এই ফ্যাসিস্টকে হটানোর জন্য যা করার দরকার তাই করবে বিএনপি। মানুষ জীবন দিচ্ছে। প্রয়োজনে লম্বা যুদ্ধে যেতে হলেও মানুষ প্রস্তুত। চলমান আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিকরা আনামদের মতো কাপুরুষ নয়।
ফলে মাহফুজ আনামদের বিএনপি নিয়ে আওয়ামী মাইন্ডসেট থেকে চিন্তিত হওয়া দেখে মনে হয়, তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে পারছেন না। নাকি জেগে জেগে ঘুমুচ্ছেন। এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার নসিহত পেশ করা গোটা জনগণের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার সমান। বিএনপি এটা করে নাই দেখে মাহফুজ আনামরা বিএনপির ভুল ধরছেন। কিন্তু বিএনপিরও যে কৌশল থাকতে পারে। এবং সেই কৌশলে আওয়ামী লীগ যে ইতোমধ্যে ধরা খেয়ে গেছে সেই হিসেব তাদের নেই। এই নির্বাচন হওয়ার আগেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে- যা বিএনপির আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। অন্যদিকে ক্র্যাকডাউন মোকাবেলা করে এবং দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে বিএনপি সরকারের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র যন্ত্রকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসের বিস্তার বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন ভীতি বা পিছু হটার মনোভাব তৈরি করতে পারেনি। বরঞ্চ “ঘরে আগুন লেগেছে” দেখে বাম-ডান- মধ্য-ধর্মীয় দল সবাই একাকার হয়ে গেছে। এটা ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্ট। মুক্তিযুদ্ধের মত জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ।সবাই এখন একসাথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। ফলে মাহফুজ আনামরা বিএনপির কৌশল না বুঝে আওয়ামী লীগের চশমায় বাস্তবতাকে দেখার ফলে জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না। তিনি এটা বুঝতে পারছেন না যে, আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে ভাঙতে না পেরে এবং দলটির আবার মাঠে ফিরে আসার কৌশলে হতাশ হয়ে পড়েছেন। আর এই হতাশা আড়াল করতে দ্রুতই প্রতিক্রিয়াশীলের মত বিএনপির পিছে পিছে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যা ইতমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত হলো- তারেক রহমানের এই ব্যাকফুটে গিয়ে আবার ফ্রন্টফুটে আগানোর এই কৌশলে আওয়ামী লীগ এবার ধরা খেয়েছে। এক পা পিছিয়ে ২ পা আগানোর এই কৌশল আওয়ামী লীগ বুঝতে পারে নাই- এটা এখন পরিস্কার। তাতে তারেক রহমানের প্রজ্ঞার প্রশংসাই করতে হয়। কিন্তু মাহফুজ আনামের মতো সাংবাদিকরাও এটা বুঝবেন না দেখে হতাশই হতে হয়। এই চরম জুলুমের অবস্থা দেখে উনারা ঘাবড়ে গেলেও আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বরং দিন দিন আরও শন্তিশালী অবস্থানে উপনিত হচ্ছেন। বিজয় সুনিশ্চিত জেনেই জীবন বাজি রেখে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। উনার গোটা লেখা জুড়ে ভীরু কাপুরুষিত মানসিকতা ও বিএনপির নেতাকর্মীদের স্পিরিটকে আন্ডারমাইন করে এমন কিছু হাস্যকর মন্তব্য করেছেন যা ইতোমধ্যে সোসাল মিডিয়াতে কৌতুকের জন্ম দিয়েছে। সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন নাই। আওয়ামী সুশীল গং এখনও বুঝতে পারছেন না যে, বিএনপির জন্য ফাঁদ পাততে গিয়ে আওয়ামী লীগই একের পর এক সেই ফাঁদে পড়ছেন। যদি আওয়ামী লীগ ৭ জানুয়ারি এই তামাশার নির্বাচন করার চেষ্টা করে তাহলে তাকে দেশে-বিদেশে চরম মূল্য দিতে হবে। চিরদিনের মতো রাজনীতি শূন্য হয়ে যাবে দলটি। সব স্বৈরশাসনের ভাগ্যে যা জুটে তাদের ভাগ্যেও সেই করুণ পরিণতি ছাড়া আর কিছু ঘটার সম্ভাবনা নাই।
মাহফুজ আনামরা যদি লীগের ভালই চান তাদের উচিৎ আওয়ামী লীগকে বুঝনো যে, বিএনপিকে ভাঙতে গিয়ে, দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ দিন দিন রাজনীতির হিসেবে গৌণ হয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের কোন রাজনীতি থাকে না। যে দানবীয় সংগঠনের উপর ভর করে সরকার এমন অত্যাচার চালাচ্ছে তা জনপ্রতিরোধে গুড়িয়ে যেতে বাধ্য। ফলে রাজনীতি শূন্য হয়ে বাংলাদেশে আগামীতে আওয়ামী লীগ করার লোক হারিকেন দিয়েও খুজে পাওয়া দুষ্কর হবে। বরং এই বিষয়টা নিয়ে মাহফুজ আনামদের চিন্তিত হওয়া দরকার। বিএনপি সঠিক লাইনেই আছে। জনগনের অধিকারের পক্ষেই আছে। এখানে কোন কৌশলের সুযোগ নাই। হয় আপনি জনগনের পক্ষে অথবা জনগনের বিপক্ষে।
মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল সবাইকেই সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রশ্নটা নৈতিক। আর এই নৈতিক প্রশ্নে মাহফুজ আনামরা শক্ত অবস্থান নিলে আজকে হয়তো জীবন বাজি রেখে এই আন্দোলনেই নামার দরকার হতো না। একটা লাইন বলেই শেষ করবো- “অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না”। জনগনের বিজয় ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন বিকল্প নাই। এটা যারা বুঝতে অক্ষম তাদের প্রতি জনগণের সুবিচার থাকবে -এটাও মনে করার কোন কারণ নাই।